পুরপ্রধান নীহারেন্দ্র।- ফাইল ছবি।
দ্বৈত কর ব্যবস্থা চালু হল শিলচর পুরসভায়। ২০১২ সালের নতুন আইন মেনে যাঁরা নিজেদের বাড়ির কর নির্ধারণ করেছেন, তাঁরা নতুন হারে কর দেবেন। যাঁদের এখনও তা হয়ে ওঠেনি, তাঁদের জন্য পুরনো হার কার্যকর থাকবে। কংগ্রেস সদস্যদের আপত্তির মধ্যেই এই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করেছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন পুরবোর্ড।
২০১২ সালের আসাম মিউনিসিপাল (অ্যামেন্ডমেন্ট) অ্যাক্ট ২০১৩ সালের এপ্রিলে কার্যকর হয়। তাতে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে কর ব্যবস্থাকে আধুনিক করে তোলার কথা বলা হয়েছে। অনেক দিন থেকেই অসমে বাড়ি বাড়ি ঘুরে পুর-নাগরিকদের সম্পত্তি নির্ধারণ ও করের পরিমাণ ঠিক করা হচ্ছিল। কর সংগ্রাহক নামে পৃথক পদও রয়েছে পুরসভাগুলিতে। তাঁরাই বাড়ি বাড়ি ঘুরে কর সংগ্রহ করেন। নতুন আইনে এই ব্যবস্থা বদলে দিয়ে ‘সেলফ অ্যাসেসমেন্ট’-এর কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ আয়করের মত নির্ধারিত নিয়মে নাগরিকরাই তাঁদের সম্পত্তির পরিমাণ নির্ধারণ করবেন। তাঁরাই বাড়িঘরের কর চূড়ান্ত করবেন, নিজেরা পুরসভায় গিয়ে তা জমা করবেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমা করতে না-পারলে বিভিন্ন অঙ্কের জরিমানা এবং অন্যান্য শাস্তির বিধান রয়েছে সংশোধিত আইনে। সে জন্য পুরসভাগুলির কর আদায় ব্যবস্থাকে কম্পিউটারের মাধ্যমে করা হয়। সম্পত্তি এবং কর নির্ধারণের সফটওয়্যারও পুরসভাগুলিকে তৈরি করতে হয়।
রাজ্যের অন্য পুরসভার সঙ্গে শিলচরও সেই কাজ শুরু করেছিল। তৎকালীন সভাপতি সুস্মিতা দেব সাংবাদিক বৈঠক করে, বিজ্ঞাপন দিয়ে নাগরিকদের শাস্তির বিষয়ে সতর্ক করেছিলেন। তিনি নির্ধারিত তারিখের মধ্যে ‘সেলফ অ্যসেসমেন্ট’ সেরে কর জমা দিতে বলেন।
কিন্তু এখন পুর-নাগরিকরা আইন মেনে কর দিতে চাইলেও পুরসভা তা নিতে পারছে না!
বর্তমান সভাপতি নীহারেন্দ্র নারায়ণ ঠাকুর জানিয়েছেন— শিলচরে পুরনো হোল্ডিং রয়েছে ২৬ হাজার। নতুন হাজার পাঁচেক। গত দু’বছরে পুরসভা পুরনোদের মধ্যে ১৩ হাজারের কর নির্ধারণের কাজ শেষ করেছে। এখনও অর্ধেক বাকি। তার উপর রয়েছে নতুন হোল্ডিং। সেল্ফ অ্যাসেসেমেন্টের নামে পুরো কর ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে। মানুষ কর দিতে চাইছেন, পুরসভা নিতে পারছে না। তার জেরে এক দিকে রাজস্ব কমে যাওয়ায় পুরসভার কাজে সমস্যা হচ্ছে। অন্য দিকে মানুষের কাঁধে করের বোঝা বেড়ে চলেছে।
কেন শেষ হচ্ছে না সেল্ফ অ্যাসেসমেন্টের কাজ? নীহারবাবু বলেন, ‘‘ওই ব্যবস্থা কিছুটা জটিল। মাঝপথে তা থেকে সরে আসারও সুযোগ নেই। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে আরও অন্তত তিন বছর লাগবে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এত দিন কর সংগ্রহ করা না গেলে পুরসভার অনেক কাজই বন্ধ হয়ে যাবে।’’ সে কারণেই বিজেপি পুরবোর্ড পুরনো প্রক্রিয়াও একই সঙ্গে চালু রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কংগ্রেসের পক্ষ থেকে অবশ্য এই সিদ্ধান্তকে আইনবিরুদ্ধ বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রাক্তন সভাপতি তমালকান্তি বণিক বলেন, ‘‘সেল্ফ অ্যাসেসমেন্ট সরকারি নির্দেশেই করতে হয়েছিল। পুরনো ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ায় আইনি সমস্যায় জড়াবে শিলচর পুরসভা। সাধারণ মানুষও বৈষম্যের শিকার হবেন। পাশাপাশি দুই বাড়ির এক জন কম হারে, অন্য জন বেশি হারে কর দেবেন, এ কেমন কথা!’’
প্রবীণ আইনজীবী নীহারবাবু অবশ্য আইনি জটিলতাকে মোটেও গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি বলেন, ‘‘আমরা আইন ভাঙছি না। আইন মেনে প্রস্তুতি অব্যাহত থাকবে, কর আদায়ও চলতে থাকবে।’’
কংগ্রেসের পুরসদস্যরা নীহারবাবুর বিরুদ্ধে ব্যর্থতার অভিযোগ তোলেন। বিরোধী দলনেতা অলক কর, সজল বণিকরা বলেন— ‘‘শহরের নালা-নর্দমা সাফাই হচ্ছে না। জঞ্জাল নিষ্কাশন নিয়েও কোনও পরিকল্পনা নেই। জলকর ৫০ শতাংশ কমবে বলে ঘোষণা করা হলেও তা কার্যকর করা যায়নি।’’ তাঁদের মতে, এ সবের কারণ একটিই। আইন ব্যবসার জন্য পুরসভার কাজে মনোযোগ দিতে পারছেন না নীহারবাবু। পুরসভার গাড়ি চড়ে বাড়ি থেকে সোজা আদালতে যান। শেষ বেলায় পুরসভায় গিয়ে কিছুক্ষণ বসেন। কংগ্রেস পুর পরিষদীয় দলের প্রচার সম্পাদক শৈবাল দত্ত বলেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী মন্ত্রিসভার দফতর বণ্টন করলেও সব ক্ষমতা নিজের হাতে রেখে অন্যদের গুরুত্বহীন করে রেখেছেন। নীহারবাবুও দফতর বণ্টন করতেও নারাজ।’’ শ্রাবণী দাস, জয়িতা ভট্টাচার্য, রঞ্জন রায়ও একই সুরে বলেন— ‘প্রবীণদের প্রাতর্ভ্রমণের জন্য গাঁধীবাগ সকালে খুলে দিতে বললে নীহারবাবু রাজি হন না। অজুহাত দেখান, তা হলে সকালেও সেখান এক-দুজন লোক রাখতে হবে। পুরসভায় লোকের অভাব রয়েছে। তিনিই নরসিংটোলার মাঠ ভাড়া দিতে চান। গরিব মানুষ বাড়িঘরের অনুষ্ঠানের জন্য পুরসভা থেকে টিন চেয়ে নিচ্ছিলেন। তিনি টিনপ্রতি দৈনিক দুই টাকা শুল্ক চাপালেন।’
সভাপতি হয়েও আইনি ব্যবসায় সময় দেওয়ার অভিযোগ মেনে নেন নীহারবাবু। তিনি বলেন, ‘‘বিধায়ক-সাংসদদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার ন্যূনতমও পুর-সভাপতিরা পান না। কাজ কোনও অংশে তাঁদের চেয়ে কম নয়। সকালে জল না পেলে ফোন, রাতে শবদাহ করতে গিয়ে কাঠ না পেলে ফোন। বেতন সাকুল্যে ১০ হাজার টাকা। সংসার চালাতে আদালতে তো যেতেই হবে।’’ তবে কাজ ফেলে রাখা বা ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার অভিযোগ মানতে নারাজ তিনি। প্রধানমন্ত্রী মোদীর সঙ্গে তুলনা টানায় গর্বিত বলে উল্লেখ করেও তিনি জানান, দুপুরে ঘণ্টাতিনেক যেমন আদালতে কাটান, তেমনি রাত আটটা পর্যন্ত পুরসভায় থাকেন।
দায়িত্ব বণ্টন নিয়ে তাঁর যুক্তি— পুরসভার বিভিন্ন কমিটিতে তিনি কংগ্রেস সদস্যদেরও রাখতে চাইছেন। দায়িত্ব দেবেন নির্দলদেরও। তাই কয়েক দিন সকলের মানসিকতা, দায়িত্ব পালনের ক্ষমতা যাচাই করে দেখছেন। নরসিংটোলার মাঠ ভাড়া খাটানোর প্রস্তাবে কংগ্রেসের সমালোচনাকে অর্থহীন বলে মন্তব্য করেন তিনি। নীহারেন্দ্রবাবু জানান, প্রস্তাব এসেছিল বলেই বোর্ডের আলোচ্যসূচিতে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। আপত্তি উঠতেই তা খারিজ হয়ে যায়। এটাই তাঁর ইচ্ছে হলে সংখ্যার জোরে পাশ করিয়ে নিতে পারতেন। টিনের উপর শুল্ক চাপানোর ব্যাপারে তাঁর মন্তব্য, ‘‘শুল্ক ছিল না বলে তিন দিনের বদলে অনেকে পনেরো দিন টিন রেখে দিতেন। অন্য জায়গায় দিনে ১৫-২০ টাকা ভাড়া। সেখানে ২ টাকায় কারও আপত্তি হবে না বলেই মনে হয়।’’ জলকর ৫০ শতাংশ কমানোর ব্যাপারে পুরসভাপতি তাঁর অঙ্গীকারের কথা ফের উল্লেখ করেন। তবে সে জন্য কয়েক দিন সময় চেনে নেন। তিনি জানান, ৫০ শতাংশ জলকরে কত রাজস্ব কমবে, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। সে জন্য ধাপে ধাপে কাজ এগোচ্ছে। চুন-ফটকিরি সরবরাহের নতুন বরাত দেওয়া হয়েছে। তা থেকে খরচ বোঝা যাবে। এর পরই জলকর আদায়ের হিসেব টানা হবে। ২ জুন তাঁর সভাপতি হওয়ার মাত্র দু’মাস পূর্ণ হচ্ছে, তা-ও মনে করিয়ে দেন।
নালা-নর্দমা সাফাই, জঞ্জাল নিষ্কাশনেও তাঁর একই বক্তব্য— ‘‘কয়েক দিন সময় দিতে হবে। না হলে কাজ হবে কী করে?’’