ঘোষণা: জাতির উদ্দেশে বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ছবি পিটিআই।
বেলা ১১টা ২৩ মিনিট। নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করলেন, পৌনে বারোটা থেকে বারোটার মধ্যে তিনি ‘গুরুত্বপূর্ণ বার্তা’ নিয়ে দেশবাসীর সামনে আসছেন।
গোটা দেশ চমকে উঠল। আবার কি নোট বাতিল! অনেকে এটিএম-এ দৌড়লেন। এ দিকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটির বৈঠক চলছে। ফলে জল্পনা শুরু হল: তবে কি মাসুদ আজহার বা হাফিজ সইদকে নিকেশ করা হয়েছে? না কি পাকিস্তান থেকে দাউদ ইব্রাহিম বা লন্ডন থেকে বিজয় মাল্যকে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে?
কৌতূহল তুঙ্গে তুলে বেলা ১২টা ১৭ মিনিটে মোদী টিভির পর্দায় আবির্ভূত হলেন। ঘোষণা করলেন, ভারতের অস্ত্রভাণ্ডারে আজ ‘অ্যান্টি-স্যাটেলাইট মিসাইল’ যুক্ত হল। পরীক্ষামূলক ভাবে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে কৃত্রিম উপগ্রহ ধ্বংস করা হয়েছে। এই ‘মিশন শক্তি’-র জোরে স্থল, জল, আকাশ, সাইবার-এর পর মহাকাশ যুদ্ধেও মহাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল ভারত।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
আমেরিকা, রাশিয়া এবং চিনের পরে চতুর্থ দেশ হিসেবে ভারতের এই সাফল্যের জন্য মোদী অভিবাদন জানিয়েছেন প্রতিরক্ষা গবেষণা সংস্থা বা ডিআরডিও-র বিজ্ঞানীদের। কিন্তু বিজেপির মঞ্চ থেকে অরুণ জেটলি এর পুরো কৃতিত্বই দিয়েছেন মোদীকে। ‘আমরা একে রাজনৈতিক ইস্যু বানাচ্ছি না’ বলেও ইউপিএ-সরকারের দিকে আঙুল তুলে বলেছেন, ২০১২-তেই বৈজ্ঞানিকরা চাইলেও ইউপিএ-সরকার এই ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির অনুমতি দেয়নি। নরেন্দ্র মোদী সেই অনুমতি দেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘মোদী এমন এক জন নেতা, যিনি ভবিষ্যতের কথা ভাবেন। তাঁর হাতে দেশ সুরক্ষিত।’’
লোকসভা নির্বাচনের প্রথম দফার ভোটগ্রহণের ১৫ দিন বাকি। এমন সময়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণার সাফল্য নিয়ে নাটকীয় রাজনীতি করে মোদী ভোটে ফায়দা তুলতে চাইছেন বলে অভিযোগ বিরোধীদের। ডিআরডিও-কে অভিনন্দন জানানোর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীকে ‘বিশ্ব নাট্য দিবস’-এর শুভেচ্ছা জানিয়ে খোঁচা দিয়েছেন রাহুল গাঁধী। আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একে বলেছেন ‘সীমাহীন নাটক’।
‘মিশন শক্তি’ কী?
প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও) এবং মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসরো)-র প্রকল্প। কক্ষপথের কৃত্রিম উপগ্রহকে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ধ্বংসের প্রযুক্তি ও তার বাস্তবায়ন এর লক্ষ্য।
কত বছরের প্রকল্প?
২০১০ সালে প্রথম ঘোষণা। প্রতিরক্ষা ও মহাকাশ বিজ্ঞান জড়িত হওয়ায় কোনও দিন এ নিয়ে প্রচার করা হয়নি। দু’বছর আগে সবুজ সঙ্কেত কেন্দ্রের, বলল ডিআরডিও।
ঠিক কী হল?
বুধবার ওড়িশার চাঁদিপুরের কাছে আব্দুল কালাম দ্বীপ থেকে ‘ব্যালিস্টিক মিসাইল ডিফেন্স ইন্টারসেপ্টর’ ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে ৩০০ কিমি উচ্চতার কক্ষপথে থাকা, ভারতেরই একটি বাতিল কৃত্রিম উপগ্রহকে ৩ মিনিটে ধ্বংস করা হয়।
লাভ কী?
অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, যোগাযোগের মতো বিষয় মহাকাশ-প্রযুক্তি নির্ভর। শত্রুপক্ষের কৃত্রিম উপগ্রহ সেই সব মহাকাশযানকে নষ্ট বা বিকল করে দিলে বিপর্যয় নেমে আসবে। শিক্ষা ও গবেষণা ক্ষেত্র ছাড়াও ১০২টি কৃত্রিম উপগ্রহ রয়েছে। এই প্রযুক্তি সেগুলিকে সুরক্ষিত করবে।
অগ্রণী কারা?
আমেরিকা, চিন, রাশিয়া। ভারত চতুর্থ।
বিতর্ক কোথায়?
১৯৬৭ সালের আন্তর্জাতিক ‘আউটার স্পেস’ চুক্তি অনুযায়ী, মহাকাশকে সামরিক ক্ষেত্র করা যাবে না। মোদীর বক্তব্য, এই প্রযুক্তির ভূমিকা সম্পূর্ণ রক্ষণাত্মক।
‘জ্যামিং’ এবং ‘ফ্লাই বাই টেস্ট’-এর বদলে ক্ষেপণাস্ত্র কেন?
‘জ্যামিং’ অর্থে প্রযুক্তির মাধ্যমে শত্রু উপগ্রহকে বিকল করা। ‘ফ্লাই বাই’ অর্থে বিমান বা ড্রোন ব্যবহার করে ধ্বংস করা। কিন্তু সরকারের বক্তব্য, প্রকল্পের লক্ষ্য মেনে এই প্রযুক্তিই উপযুক্ত। এখন সেন্টিমিটার মেপে অভিযান সম্ভব, দাবি ডিআরডিও-র।
ভোটের আগেই পরীক্ষা কেন?
কেন্দ্রের দাবি, সাফল্য নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হওয়ার পরেই পরীক্ষা হয়েছে। ভোটের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই।
ভোটের মুখে মোদীর আজকের ঘোষণায় নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ হয়েছে বলেও নির্বাচন কমিশনের কাছে অভিযোগ জানিয়েছে বিরোধীরা।
সেই অভিযোগ খতিয়ে দেখতে রাতেই একটি কমিটি গঠন করেছে কমিশন। যদিও কমিশনের একটি সূত্রের মতে, জাতীয় সুরক্ষা ও বিপর্যয় মোকাবিলা নির্বাচনী বিধির আওতায় আসে না।
কংগ্রেসের এক সম্মেলনে রাহুল বলেন, ‘‘ঘোষণার সময় প্রধানমন্ত্রী চেহারা দেখেছেন? উনি বুঝতে পেরেছেন যে কংগ্রেস এ বার ‘ন্যায়’ দেবে। মোদীজি এ বার ভয় পেয়েছেন যে ওঁর যাওয়ার সময় এসে গিয়েছে।’’
দু’দিন আগেই কংগ্রেস ক্ষমতায় এলে গরিবদের জন্য মাসে ৬ হাজার টাকা করে ন্যূনতম আয় বা ‘ন্যায়’ প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন রাহুল। পুলওয়ামা-বালাকোট পরবর্তী অধ্যায়ে তৈরি জাতীয় সুরক্ষা থেকে নজর সরে গিয়ে রাজনীতি এখন রাহুলের প্রতিশ্রুতি ঘিরেই আবর্তিত হচ্ছে।
বিরোধীদের অভিযোগ, মোদী যা করলেন, তা উগ্র জাতীয়তাবাদে ফেরার মরিয়া চেষ্টা। তিনি বলেন, ‘‘আমরা একজোট হয়ে শক্তিশালী, সুরক্ষিত ভারত নির্মাণ করব। আমি এমন ভারতের পরিকল্পনা করি যে নিজের সময় থেকে দু’কদম এগিয়ে ভাবে ও চলার সাহস জোটাতে পারে।’’ তিন বার ভারত মাতার নামে জয়ধ্বনি দিয়ে বক্তৃতা শেষ করেন মোদী।