তখন ১১ বেজে ৪১ মিনিট। কেউ অফিসে, কেউ বা দোকানে, আবার কেউ বা পথচলতি। সকলেই ভাবছেন মাথা ঘুরছে। কেউ অফিসের চেয়ারে বসে ভাবছেন, পিছন থেকে কোনও সহকর্মী বুঝি তাঁকে ধাক্কা মারছেন। কিন্তু সব ভাবনাই এক লহমার। পলক ফেলতে না ফেলতেই কী হচ্ছে মানুষ তা বুঝে গেলেন। ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। ভূমিকম্পের তীব্রতায় হুড়মুড়িয়ে অফিস, দোকান, মল--যে যেখানে ছিলেন সেখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায়। মানুষের ভিড়ে পটনার রাস্তা তখন লোকে লোকারণ্য। যানবাহন স্তব্ধ। পটনাবাসী বুঝে উঠতে পারছেন না কী করবেন, কোথায় যাবেন!
কয়েক দিন আগেই কালান্তক ঝড়ে ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে বিহারে। তার রেশ না-কাটতেই ফের ভূমিকম্পের হানা। ফলে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক যেন বেশি করে চেপে বসে। পটনার ফ্রেজার রোডের একটি বহুতল পতাকার মতো দুলছিল। সেই বাড়িতে রয়েছে গেস্ট হাউস। নীচে একটি নামী ব্র্যান্ডের জুতোর দোকান। কম্পনের ফলে হুড়মুড়িয়ে মানুষ সেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছিল। ভিড়ের মধ্যে দেখা গেল বিজেপির এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ বিধান পরিষদের সদস্যকেও। প্রতাপ নেই, চোখে মুখে আতঙ্ক। গেস্ট হাউস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন রাস্তায়। পরণে স্রেফ পাজামা-গেঞ্জি। সঙ্গী পারিষদ দলও তখন ছিটকে গিয়েছে। আপনি বাঁচলে তবে তো নেতাজি!
পটনার এই আতঙ্কের ছবি আরও প্রকট গাঁধী ময়দানে। ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবার নিয়ে পায়ে হেঁটে, গাড়ি নিয়ে, যে যেমন পারেন চলে এসেছেন ময়দানে। খোলা আকাশই তখন নিরাপদ আশ্রয়। গাঁধী ময়দানের ভিড় দেখে মনে হচ্ছিল শীতকালীন পিকনিকের দৃশ্য। গাঁধী ময়দানে আশ্রয় নেওয়া শ্রবণ কুমারের কথায়, “আমার পরিবারের ছ’জনকে নিয়ে এখানে চলে এসেছি। যখন দেখলাম টেবিলে রাখা জলের বোতলগুলি মাটিতে পড়ে গেল তখনই মনে হল কিছু একটা হয়েছে। তার পরই বুঝতে পারি কী হচ্ছে। দেরি না করে যে অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থাতেই বেরিয়ে আসি।’’ এ ক্ষেত্রে খোলা, বিশাল গাঁধী ময়দানই যে একমাত্র নিরাপত্তার জায়গা তা ভেবে নিতে শ্রবণ কুমাররা ভুল করেননি। একই অনুভূতি ফ্রেজার রোডের বাসিন্দা সবিতা কুমারের। তাঁর কথায়, “এমন ভূমিকম্প আগে দেখিনি। এতক্ষণ ধরে যে ভাবে ঘরবাড়ি কাঁপিয়ে দিন তাতে বুঝতে পেরেছিলাম বড় কোনও অঘটন ঘটতে চলেছে। তাই বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি মাঠে।” এর মধ্যে বৃষ্টি এসে পড়ায় মাথা বাঁচাতে গাড়ির সঙ্গে ত্রিপল খাটিয়ে অনেকেই তৈরি করে নিয়েছেন তাঁবু।
পটনার ফ্রেজার রোডে নতুন তৈরি একটি মলের প্রায় শ’খানেক কর্মী বিকেল পর্যন্ত সেখানে ফেরেননি। এমনকী ওই মলের প্রধান দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ফলে কোনও ক্রেতাও ঢুকছে না। একই পরিস্থিতি পটনার নালা রোড বা সবজি বাগ কিংবা কদমকুঁয়া এলাকায়। সেখানকার বাসিন্দারা যে যার বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন। কম্পন শেষ হওয়ার পরেও বাড়িতে ঢুকতে সাহস পাচ্ছিলেন না। এই ভূমিকম্পের রেশ যে কোনও সময় ফের ফিরে আসতে পারে, শুধু এই ভাবনা থেকেই পরবর্তী দু’ঘণ্টা পটনাবাসীর নিরাপদ আশ্রয় ছিল খোলা আকাশ, সবুজ ময়দান কিংবা চওড়া রাস্তা।
সন্ধ্যা পর্যন্ত বহু মানুষ রয়ে গিয়েছেন ওই গাঁধী ময়দানেই। খবর পেয়ে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার সরাসরি হাজির হন গাঁধী ময়দানে। কথা বলেন আতঙ্কিত মানুষজনের সঙ্গে। আশ্বস্ত করেন। জানান, রাতেও তিনি জেগেই থাকবেন।