Economic slowdown

বেহাল কোষাগার সামলাতেই তেলের দাম বাড়িয়ে চলেছে সরকার

সাধারণ অবস্থায় সরকারের আয়ের ২০ শতাংশের মতো আসে পেট্রলিয়াম পণ্যের বিক্রি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির কাছ থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ড থেকে।

Advertisement

সুপর্ণ পাঠক

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ জুন ২০২০ ২০:২৩
Share:

গ্রাফিক: তিসায়া দাস।

শিরোনামে পেট্রল বা ডিজেলের দাম। সংবাদ মাধ্যম বলছে বাজার খুলেছে। এখন পেট্রল বা ডিজেলের চাহিদা, করোনার আগে বাজারে যে চাহিদা ছিল তার ৮০ শতাংশ। আগামী কয়েক দিনেই তা স্বাভাবিক হবে। বাজারে অশোধিত তেলের দামও কই ঊর্ধমুখী তো নয়! তাই যদি হয়, তা হলে কেন বাজারে তেলের দামে আগুন? কারণ সোজা। এক তো করোনার ছোবলে বাজার বন্ধ। তায় অর্থনীতিতে সংকোচন চলছে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে। গত কয়েক বছর ধরেই।

Advertisement

বাজারে কেনাবেচা হলে সরকারের আয় হয় কর থেকে। আমি আপনি আয় করলে সরকারের আয় হয়, আবারও সেই করের টাকা থেকেই। কিন্তু সরকারের একটা সমস্যা আছে। বছরের শুরুতেই সরকারকে অনুমান করতে হয় আগামী বছরে কত আয় হতে পারে। আর সেটা করতে গেলে সরকারকে ধরে নিতে হয় জাতীয় উৎপাদন কতটা বাড়বে। কারণ জাতীয় উৎপাদন বাড়লে, বাড়বে কর বাবদ আয়ও।

কিন্তু এই বৃদ্ধি কতটা হবে, তার অঙ্কটা বাস্তবকে এড়িয়ে করা যায় না। আমরাই বা পারি কি? নতুন বছরে কত মাইনে বাড়বে তা আমরা একটা আন্দাজ করি আগের বছরগুলিতে কতটা বেড়েছে আর তার সঙ্গে মিলিয়ে নিই চলতি বছরে সংস্থার হাল। সরকারের অঙ্কটাও সেই একই রাস্তায় হাঁটে। আমরা যদি অঙ্কটা ভুল করে বিমা বা অন্য খাতে খরচ বাড়িয়ে রাখি, আর বছর শেষে দেখি যে মাইনে বাড়ল না, তা হলে আমাদের যা হাল হয়, কেন্দ্রীয় সরকারেরও গত কয়েক বছর ধরে হাল সেই রকমই।

Advertisement

এটা মাথায় রেখেই ফিরি পেট্রোল ও ডিজেলের দামের প্রসঙ্গে। সাধারণ অবস্থায় সরকারের আয়ের ২০ শতাংশের মতো আসে পেট্রলিয়াম পণ্যের বিক্রি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির কাছ থেকে পাওয়া ডিভিডেন্ড থেকে। মনে রাখতে হবে পেট্রল বা ডিজেলের দাম যাই বাড়ুক না কেন তার ন্যূনতম চাহিদা কিন্তু একই থাকবে। তা নিয়ে যতই আমরা গাঁইগুঁই করি না কেন। কারণ এই দুই জ্বালানি ছাড়া আমাদের জীবন আক্ষরিক অর্থেই অচল।

আরও পড়ুন: কথাবার্তা চলছে, আমরা আর কোনও সংঘর্ষ চাই না, বলল বেজিং

তাই অশোধিত তেলের দাম পড়লেও, বাজারে তেলের দাম যদি একই মাত্রায় থাকে বা বাড়ানো হয় তা হলে লাভ হয় দুই দিক দিয়ে। সরকারের কোষাগারে শুল্ক বাবদ লাভ বাড়ে, আর সংস্থাগুলির লাভ বাড়লে সরকারের ঘরে ডিভিডেন্ড বাবদ আয়ও বাড়ে। তাই কোষাগারে চাপ বাড়লে সরকার অনেক কিছুর সঙ্গে পেট্রল ও ডিজেলকেও আয় বাড়ানোর রাস্তা হিসাবে দেখে থাকে।

এটা মাথায় রাখা জরুরি যে এই দোষে বর্তমান সরকারই একা দোষী নয়। ইউপিএ-ও এই একই রাস্তায় হেঁটেছিল এবং তখন বিরোধী আর এখন সরকারের আসনে সমাসীন বিজেপি প্রবল আন্দোলন করেছিল তার বিরোধিতা করে।

কিন্তু ফেরা যাক মূল প্রসঙ্গে। বর্তমান সরকারের স্লোগানের অন্যতম অংশ ছিল দেশের বৃদ্ধির হার। শুধু তাই নয় বিশ্ব বাজারে অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি হিসাবে নিজেদের দাবি ও সেই দাবির ভিত্তিতে নিজেদের সাফল্যের প্রচার বিজেপি সরকারের স্বপ্ন ফেরির অন্যতম অস্ত্র। তখনও ছিল এবং এখনও আছে। এর বাজারের উপর প্রভাব কিন্তু, সরকারি তথ্যই বলছে, খুব সুবিধার হয়নি। যেমন পেট্রল বা ডিজেলের দাম। অশোধিত তেলের দাম বাড়লে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে। কিন্তু কমার সময় সে পতনে কত যেন কুণ্ঠা। কারণ, বাস্তবে বৃদ্ধির হার গত কয়েক বছর ধরেই সরকারের অনুমানকে ভুল প্রমাণ করে তলার দিকেই থেকেছে। ফল কোষাগারে চাপ।

আরও পড়ুন: ভারত শান্তি চায়, কিন্তু প্ররোচনা এলে জবাব দিতেও তৈরি: প্রধানমন্ত্রী​

আসলে ২০১৭ সাল থেকেই দেশের অর্থনীতি একটু বেকায়দায়। এ ব্যাপারে বিভিন্ন আর্থিক বিশেষজ্ঞ সাবধান করলেও নীতি নির্ধারকরা তা দীর্ঘকালীন সমস্যা বলে মানতে চাননি। এমনকি বেকারের সংখ্যা রেকর্ড অঙ্কে পৌঁছলেও সরকার তা মানতে অস্বীকার করেছে।

পাশাপাশি, বাস্তবকে এড়িয়ে, বাজেট করার সময় এ সত্য না মেনে কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৭-১৮ সাল থেকে ক্রমাগত ১২ শতাংশের আশেপাশে বৃদ্ধির হার ধরে নিজের আয়ের অঙ্ক কষেছে। এই অতি আশাবাদের ফল আমরা ২০১৯ সালেই দেখেছি। কোষাগার সামলাতে শীর্ষ ব্যাঙ্কের তহবিল থেকে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকা নিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল বর্তমান সরকার। এর কারণ একটাই— বৃদ্ধির হার নিয়ে ভুল অঙ্ক। তার ফলে বেশি আয়ের অনুমান। আর যার ফলে প্রতিশ্রুত ব্যয় মেটাতে বাজেটের হিসাবে টান।

চলতি বছরে অবশ্য সরকার বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ ধরে বাজেটের অঙ্ক কষেছে। কিন্তু গত বছর শেষ হয়েছে ১১ শতাংশে (এই সব হার কিন্তু চলতি দামের হিসাবে)। দেশের আর্থিক সংকোচনের গতির সঙ্গে কিন্তু এই বৃদ্ধিকেও আশার ছলনা বলে মনে করেছিলেন অনেকে। তখন অবশ্য আমরা কেউই ভাবতে পারিনি যে করোনা বাজার থেকে তিন মাসের মতো ব্যবসা ছিনিয়ে নেবে। যার অবশম্ভাবী অভিঘাত শুধু আমার আপনার আয়ের উপরই পড়বে তা নয়, কোষাগারকেও তলানিতে ঠেলবে এতটাই।

মাথায় রাখতে হবে পেট্রলিয়াম খাতে সরকারের কর ও ডিভিডেন্ড বাবদ আয় দাঁড়ায় ৩ লক্ষ ৮০ হাজার কোটি টাকার মতো। করোনার অভিঘাতে স্বাভাবিকের থেকেও বেশি সংকোচন হবে দেশের অর্থনীতিতে। এমনিতেই অন্যান্য কর খাতে সরকারের আয় ক্রমাগত কমছিলই কয়েক বছর ধরে বাজারের সংকোচনের কারণে। এ বারে তো কোষাগারে মুগুরের আঘাত! তাই হাতের কাছে আয় বাড়ানোর এত সহজ অস্ত্র কি এই সরকার ছাড়বে? অশোধিত তেলের দাম যাই হোক না কেন, বাজারের যতই বেহাল অবস্থা হোক না কেন, কোষাগার বাঁচাতে নাগরিকের পকেটই শেষ গন্তব্য সরকারের। তাই আমাদের তেলের দাম কমার আশাও ভুল। অন্য উপায় ছিল কি না তা অন্য আলোচনা দাবি করে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন