জলমগ্ন আইসিইউ। শুক্রবার চেন্নাইয়ে। ছবি: পিটিআই।
ডেয়ার নদীর কাছেই হাসপাতালটা। চেন্নাইয়ের নামী বেসরকারি হাসপাতালগুলোর অন্যতম। দেওয়ালি থেকে টানা বৃষ্টি চলছিল। গত কয়েক দিনে অবস্থা আরও ঘোরালো হয়েছে। তার মধ্যে নদী ঢুকে এল হাসপাতাল চত্বরে। জেনারেটর রুম জল থইথই। ফলে ভেন্টিলেটর বা কৃত্রিম অক্সিজেনের সংযোগ গেল বন্ধ হয়ে।
নামী হাসপাতালে আইসিইউ-এর বিছানায় শুয়েই শেষ নিঃশ্বাস নিতে বাধ্য হলেন ১৮ জন রোগী। বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবেই এঁদের মৃত্যু হয়েছে বলে পরিজনদের অভিযোগ। এঁরা প্রত্যেকেই বৃহস্পতি থেকে শুক্রবারের মধ্যে মারা গিয়েছেন বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে।
চেন্নাইয়ের রওয়াপেট্টা সরকারি হাসপাতালে একের পর এক দেহগুলো আসছিল। শুক্রবার মোট ৪৪টি দেহ এসেছে। তার মধ্যে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের বলি অনেকেই। আর ১৪টি দেহ এসেছে মনাপক্কম এলাকার ওই বানভাসি হাসপাতালের আইসিইউ থেকে। মৃত ১৮ রোগীর মধ্যে বাকি চার জনের সরাসরি পরিবারের হাতে তুলে দিয়েছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সব রকম চেষ্টা করেও পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় এই ট্র্যাজেডি ঠেকানো যায়নি, দাবি করেছেন তাঁরা।
স্বাভাবিক ভাবেই স্বজনহারা পরিবারগুলির তরফে হাসপাতালকে দায়ী করা হচ্ছে। উঠছে গাফিলতির অভিযোগ। বৃষ্টির ভাবগতিক বুঝে আগে থেকে জেনারেটরের ব্যাক-আপ কেন বাড়িয়ে রাখা হয়নি, পরিজনদের প্রশ্ন সেটাই। তামিলনাড়ু সরকার ঘটনাটি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। রাজ্যের মুখ্যসচিব কে জ্ঞানদেশিকন মানছেন যে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাদের কর্তব্য করেননি। সরকারি স্বাস্থ্য দফতরকেই পরিস্থিতি সামাল দিতে এগিয়ে আসতে হয়েছে। স্বাস্থ্যসচিব জে রাধাকৃষ্ণন নিজে ওই হাসপাতাল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন। জলে ডুবে জেনারেটর যে বন্ধ, সেটা তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। বাড়তি জেনারেটরের ব্যবস্থা যে নেই, দেখেছেন সেটাও। তবে রাধাকৃষ্ণন একই সঙ্গে এ-ও বলছেন যে, বিদ্যুৎ সংযোগের অভাবেই রোগীরা মারা গিয়েছেন কি না, তদন্তের আগে সেটা বলা উচিত নয়। আপাতত একশোরও বেশি অ্যাম্বুল্যান্স বেসরকারি ওই হাসপাতাল থেকে রোগীদের সরকারি হাসপাতালে সরাচ্ছে।
বছর চারেক আগে কলকাতার একটি নামী বেসরকারি হাসপাতালে অগ্নিকাণ্ডের জেরে ৯৫ জন রোগী মারা গিয়েছিলেন। অভিযোগ উঠেছিল, আগুনটা একতলার নীচের গুদামঘরে লাগা সত্ত্বেও হাসপাতালের গাফিলতিতেই এসি পাইপের মধ্য দিয়ে ধোঁয়া চলে যায় উপর তলার রোগীদের কেবিনে। আগুনে পুড়ে নয়, দমবন্ধ হয়ে মারা যান তাঁরা। চেন্নাইয়ের হাসপাতালের ঘটনা এ দিন সেই স্মৃতি উস্কে দিয়েছে অনেকের মনে। যদিও কলকাতার সেই ঘটনা ছিল হাসপাতালের একটি বিচ্ছিন্ন অগ্নিকাণ্ড। আর চেন্নাই এক প্রবলপ্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ফলে এই দু’টো ঘটনা, দু’টো পরিস্থিতি এবং দু’টো ‘গাফিলতি’র তুলনা চলে না বলেও স্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞদের অনেকের মত।
একটানা বৃষ্টিতে জলমগ্ন চেন্নাই তিন দিন ধরেই নিষ্প্রদীপ। হাসপাতালগুলিতে জেনারেটরের সাহায্যেই কাজ চলছে। অভিযুক্ত হাসপাতালে তা হলে কেন সমস্যা হল? সংবাদমাধ্যমের একাংশের কাছে হাসপাতালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর পৃথ্বী মোহনদসের দাবি, অ্যাডেয়ার নদীর জল যে এ ভাবে হাসপাতালে হু হু করে ঢুকে পড়বে, এটা আগে ভাবা যায়নি। পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়নি সেই কারণেই। তাঁর কথায়, হাসপাতালের দেওয়াল ভেঙে মঙ্গলবার রাতে ঘরে ঢুকে আসে নদী। তখন প্রথমে ৩০ জন রোগীকে অন্য একটি ব্লকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘‘বুধবার সকাল থেকে আর কিচ্ছু কাজ করছিল না। সব ক’টা জেনারেটর বিকল হয়ে গেল। ভেন্টিলেটর, মনিটর থমকে গেল। আমরা গায়ে-গতরে যতটা পারলাম রোগীদের সরানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু সবাইকে পারিনি।’’
হাসপাতাল সূত্রের খবর, সেখানে মোট ৭০০ রোগী ভর্তি ছিলেন। জল বাড়ছে দেখেও জেনারেটরের ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হল না কেন? মোহনদসের দাবি, হাসপাতালের মূল আটতলা ভবনটি এমনিতে অনেক উঁচু। গত একশো বছরে বন্যার সর্বোচ্চ জলস্তর যে উচ্চতা স্পর্শ করেছে, তার চেয়ে চার গুণ উঁচু করে বানানো বাড়িটি। ফলে সেখানে জল ঢুকে যাবে, এমনটা আগে থেকে আশঙ্কা করেননি কর্তৃপক্ষ। ফোনও কাজ করছিল না, ফলে বাইরে থেকে সাহায্য পেতেও দেরি হয়েছে বলে দাবি। বৃহস্পতিবার থেকে সরকারি উদ্ধারকাজ শুরু হয়। বৃহস্পতি-শুক্র দু’দিনে ৩৫০ রোগীকে অন্যান্য হাসপাতালে সরানো হয়েছে।
১৮ জন রোগী সে সুযোগ পেলেন না। প্রত্যেকেই অত্যন্ত গুরুতর অসুখে ভুগছিলেন। তাঁদের পরিবারগুলির বিলাপ আর হাহাকার এখন শুধু একটা কথাই জানতে চাইছে, কোনও রকম বিকল্প কি সত্যিই ছিল না? কিছুই করা গেল না?