বস্তির আগুনে জীবন্ত দগ্ধ অসুস্থ প্রৌঢ়া

আগুনে ছাই হল জনাচল্লিশেক পরিবারের সর্বস্ব। ভস্মীভূত হয় শিলচর চেংকুড়ি রোডের পুরো বস্তি। চতুর্দিকে আগুন ধেয়ে আসছে দেখেও ঘর থেকে বেরোতে পারেননি শয্যাশায়ী মমতা দাস। জীবন্ত দগ্ধ হন অসুস্থ বৃদ্ধা। দুই মেয়েকে অগ্নিকুণ্ড থেকে বের করে আনতে গিয়ে জখম হন রাধাকৃষ্ণ দাস ও দীপা দাস।

Advertisement

উত্তম সাহা

শিলচর শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০৪:২১
Share:

আগুনের গ্রাসে চেংকুড়ি রোডের ঘটনা।নিজস্ব চিত্র

আগুনে ছাই হল জনাচল্লিশেক পরিবারের সর্বস্ব। ভস্মীভূত হয় শিলচর চেংকুড়ি রোডের পুরো বস্তি। চতুর্দিকে আগুন ধেয়ে আসছে দেখেও ঘর থেকে বেরোতে পারেননি শয্যাশায়ী মমতা দাস। জীবন্ত দগ্ধ হন অসুস্থ বৃদ্ধা। দুই মেয়েকে অগ্নিকুণ্ড থেকে বের করে আনতে গিয়ে জখম হন রাধাকৃষ্ণ দাস ও দীপা দাস। চার জনই শিলচর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি।

Advertisement

গত রাতের আগুন আক্ষরিক অর্থেই নিঃসঙ্গ করল ৭০ ছুঁই ছুঁই শিবচরণ দাসকে। এক সময় ছিলেন দিনমজুর। বার্ধক্যের দরুন জীবিকা হারিয়েছেন কিছু দিন। ক’বছর আগে হারিয়েছেন একমাত্র সন্তানকে। কাজ হারানোর পর থেকে প্রতিবেশীরাই দু’বেলা দু’মুঠো খেতে দেন।

এই বাঁচাতেই আনন্দ পেতেন শিবচরণ। স্ত্রী মমতার সঙ্গে মন খুলে কথা বলতেন। বছরতিনেক ধরে শয্যাশায়ী ৬২ বছরের মমতা। প্রথমে হাঁটতে-চলতে কষ্ট হতো। প্রায়ই রাত জাগতেন পায়ের খিচুনির জন্য। পরে উঠতে-বসতেও সমস্যা বাড়ে। অর্থাভাবে চিকিৎসা হয়নি। বিছানাতেই পড়ে থাকতেন দিন-রাত।

Advertisement

শিবচরণবাবু বলেন, ‘‘আগুন লেগেছে, টের পাইনি। হঠাৎ গরম হাওয়ায় ঘুম ভাঙে। দেখি ঘরে আগুন। মমতাও চিৎকার করতে থাকে।’’ তাঁর কথায়, ‘‘মমতাকে ধরে বিছানা থেকে তোলার চেষ্টা করি। পারিনি। ততক্ষণে ঘর থেকে বেরনোর রাস্তাও প্রায় বন্ধ হয়ে পড়ে। উত্তাপে টিকতে পারছিলাম না। বাধ্য হয়ে বেরিয়ে আসি। ভেবেছিলাম, অন্যদের সাহায্য নিয়ে মমতাকে বের করা সম্ভব হবে। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি।’’

রাত থেকেই আগুনের আঁচ আর কান্নার আওয়াজে বাতাস ভারী হয়ে ওঠে শিলচরে। রাজ্য অগ্নিনির্বাপক বাহিনী ছাড়াও ওএনজিসি, বিমান ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর ৭টি দমকল ইঞ্জিন আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। সকাল থেকেই প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের নির্দেশে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জীবনজ্যোতি প্রকল্পে মমতাদেবীর স্বামী শিবচরণ দাসের নামে ৪ লক্ষ টাকা মঞ্জুর হয়। হাসপাতালে গিয়ে রাধাকৃষ্ণবাবু ও তাঁর স্ত্রী-কন্যাদের দেখে আসেন বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার তথা স্থানীয় বিধায়ক দিলীপকুমার পাল। তাঁদের চিকিৎসায় যেন গাফিলতি না হয়, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে বলে যান তিনি।

বিভিন্ন সংস্থার ত্রাণে গণভোজের ব্যবস্থা হয়েছে। পুরসভার বিজেপি সদস্যরা মিলেমিশে ৪০ পরিবারের জন্য ৪০টি কম্বল ও সকলের জন্য শাড়ি-ধুতি কিনেছেন। পুরপ্রধান নীহারেন্দ্র নারায়ণ ঠাকুর হাজির থেকে সে সব বিলি করেছেন। সোনাইয়ের বিধায়ক আমিনুল হক লস্কর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে দিয়েছেন পরিবার-পিছু ১০ হাজার টাকা। এ ছাড়াও, বেশ কিছু মানুষ নিজেদের বাড়িঘরের পুরনো জামাকাপড় নিয়ে হাজির হয়েছেন আগুনে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে। জেলা প্রশাসন প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে সব দিকে খেয়াল নেই মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সঙ্গীতা দাসের। কে আসছেন, কে যাচ্ছেন দেখতেই চায় না সে। সারাক্ষণ ভেবে চলেছে, মাধ্যমিকের বাকি পরীক্ষাগুলি দেবে কী করে। শুধু ইংরেজি, অঙ্ক হয়েছে। আগামী কাল বিজ্ঞান পরীক্ষা। রাত পোহালেই যেতে হবে নরসিং স্কুল পরীক্ষাকেন্দ্রে। আগুনে বইপত্র জ্বলে গিয়েছে। পড়ার মন বা পরিবেশ কোনওটাই নেই এই সময়ে। তার চেয়ে বড় চিন্তা, অন্য সব কিছুর সঙ্গে জ্বলে ছাই হয়ে গিয়েছে তার অ্যাডমিট কার্ডও। সেটি ছাড়া পরীক্ষার হলে ঢুকবে কী করে! আর ঢুকেই বা করবে কী! তার যে রোল নম্বরই মনে নেই।

মনমোহন মজুমদার বালিকা বিদ্যালয়ের পড়ুয়া সঙ্গীতার আক্ষেপ, বেরনোর সময় যদি অন্তত অ্যাডমিট কার্ডটা হাতে নিতে পারত! সে জানায়, তখন সে পড়ছিল। টের পেয়ে বেরোতেই দেখে একেবারে ঘরের সামনে আগুন। ‘প্রস্তুতি’ বই হাতে সেই যে বেরিয়েছিল, আর ঢোকা সম্ভব হয়নি। দেখতে দেখতে পুরো ঘর ভস্মে পরিণত হয়। সঙ্গে তাঁর সেই অ্যাডমিট কার্ডটিও। একই অবস্থা রাধামাধব কলেজের ছাত্র প্রহ্লাদ দাসেরও। উচ্চমাধ্যমিকের প্রথম পরীক্ষা শেষ হয়েছে শুধু। কাল দ্বিতীয়টি। অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে দুশ্চিন্তায় সে-ও।

ডেপুটি স্পিকার দিলীপকুমার পাল অবশ্য জেলাশাসককে তাদের পরীক্ষায় বসার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিয়েছেন। আশ্বস্ত করেছেন বিএ চতুর্থ সেমিস্টারের পরীক্ষার্থী শুভ্রজিৎ দাসকেও। কী করে আগুন লেগেছে, তার উত্তর কারও জানা নেই। দমকল বাহিনীর শিলচর প্রধান বিদ্যাধর বে জানিয়েছেন, ঘরে ঘরে গ্যাসের সিলিন্ডারের বিস্ফোরণে মুহূর্তে তা ভয়ানক চেহারা নেয়। পুলিশ সুপার রাকেশ রৌশন বলেন, ‘‘প্রাথমিক তদন্তে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণকেই কারণ হিসেবে ধরা হচ্ছে। তবু অনুসন্ধান অব্যাহত থাকবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন