ললিত মোদী বিতর্কে বিব্রত নরেন্দ্র মোদীর অস্বস্তি বাড়ালেন লালকৃষ্ণ আডবাণী।
প্রধানমন্ত্রী পদের দৌড়ে শিষ্যের কাছে হার হয়েছিল গুরুর। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে দল ও সরকারেও কার্যত ব্রাত্য হয়ে গিয়েছেন তিনি। নখদন্তহীন ‘মার্গদর্শকমণ্ডলী’র সদস্য করে আডবাণীর ‘শোকগাথা’ প্রায় লিখেই ফেলেছে বিজেপি। ৮৭ বছরের ‘লৌহপুরুষ’ তবু ফুরিয়ে যেতে নারাজ। গত এক বছর মোদীর দাপট তুঙ্গে থাকায় মুখ খোলেননি। কিন্তু ললিত-কাণ্ড তাতে টোল ফেলতেই ফের গা-ঝাড়া দিলেন তিনি। আডবাণী বললেন, দেশে আবার জরুরি অবস্থা জারির যথেষ্ট সম্ভাবনা দেখছেন তিনি। যে মন্তব্যের লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদী বলেই মনে করছে, বিরোধীরা তো বটেই, শাসক দলের বড় অংশও।
আগামী সপ্তাহে জরুরি অবস্থা জারির ৪০ বছর পূর্ণ হচ্ছে। কংগ্রেসকে বিপাকে ফেলতে এই বর্ষপূর্তি সাড়ম্বরেই পালন করার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আডবাণীর বক্তব্য বিজেপি-বিরোধীদের হাতেই অস্ত্র তুলে দিয়েছে।
কী বলেছেন আডবাণী?
বিজেপির বর্ষীয়ান নেতার বক্তব্য, ‘‘সংবিধান ও আইনের তোয়াক্কা না করে যে সব শক্তি গণতন্ত্রকে ধ্বংস করতে পারে, তাদেরই এখন বাড়বাড়ন্ত। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব এখন আগের থেকে অনেক বেশি পরিণত। কিন্তু তাতে কিছু খামতি থাকায়, জরুরি অবস্থা যে আবার ফিরে আসবে না— এমনটা জোর দিয়ে বলা যায় না।’’ কেন্দ্রে বিজেপি শাসিত সরকার থাকা সত্ত্বেও আডবাণী যে ভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তা যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন বিরোধীরা। তাঁদের দাবি, পরোক্ষে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্ব নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন আডবাণী। বিজেপির একটি অংশের আবার ব্যাখ্যা, মোদীকে নিশানা করে পরোক্ষে নিজের ঘনিষ্ঠ সুষমা স্বরাজের পিঠ বাঁচাতেই সক্রিয় হয়েছেন আডবাণী। গোটা সুষমা বিতর্কটি সংবাদমাধ্যমে ফাঁস করে দেওয়ার পিছনে মোদী-ঘনিষ্ঠ এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীই যে দায়ী, সেই সম্ভবনা উস্কে দিয়েছেন দলীয় নেতারাই। এই ভাবে নিজের কার্যসিদ্ধিতে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করার বিষয়টি কার্যত জরুরি অবস্থাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে, মোদী ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের কৌশলে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন আডবাণী।
পড়ে পাওয়া এই সুযোগ কাজে লাগাতে দেরি করেননি বিরোধীরা। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালের টিপ্পনি— দিল্লিতে ইতিমধ্যেই জরুরি অবস্থা প্রয়োগ করা শুরু করেছেন মোদী। আডবাণীকে সমর্থন জানিয়েছেন বিহারের কট্টর মোদী-বিরোধী নেতা নীতীশ কুমারও। যাদের বিপাকে ফেলতে জরুরি অবস্থা জারির বিষয়টি প্রচারে তুলে আনতে চেয়েছিল বিজেপি, সেই কংগ্রেসও এখন আডবাণীর মন্তব্যকে শাসক দলের নেতৃত্বের লড়াই হিসেবে ব্যাখ্যা করে মজা লুটতে চাইছে।
বিজেপি অবশ্য প্রকাশ্যে আডবাণীর মন্তব্যে বিষ থাকার বিষয়টি অস্বীকারই করছে। দলের মুখপাত্র এম জে আকবরের দাবি, বর্ষীয়ান নেতা দার্শনিক ভাবে গোটা বিষয়টি বোঝাতে চেয়েছেন। তিনি কোনও ব্যক্তিবিশেষকে আক্রমণ করেননি। বিজেপি নেতারা অবশ্য ঘরোয়া ভাবে এটাও স্বীকার করে নিচ্ছেন, দল ও সরকারের কার্যপদ্ধতি নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে আডবাণীর। প্রবীণ ওই নেতা তাই মোদীকে সরাসরি নিশানা না-করে জরুরি অবস্থার উল্লেখ করে ঘুরিয়ে আক্রমণ শানিয়েছেন। যাতে এক ঢিলে অনেকগুলি পাখি মারা সম্ভব হয়।
দলও স্বীকার করছে, সুষমা প্রশ্নে গত এক বছরে এই প্রথমবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে মোদীর কর্তৃত্ব। মানবিকতার দোহাই দিয়ে ললিত মোদীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন সুষমা। ঘটনাটির সঙ্গে সরাসরি দুর্নীতির যোগ না থাকলেও, অন্তত নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্নের মুখে মোদীর কর্তৃত্ব। লোকসভা নির্বাচনের আগে আডবাণী-রাজনাথ-সুষমারা না চাইলেও বিপুল জনমতকে পাশে পেয়েছিলেন মোদী। সেই জনসমর্থনই এ যাবত শক্তি ছিল মোদীর। কিন্তু দিল্লির নির্বাচন বুঝিয়েছে, সেই জনমতেও ক্ষয় শুরু করেছে। যার ফলে সাংসদেরা প্রকাশ্যে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। সাক্ষী মহারাজদের মতো নেতাদের বার বার বলেও চুপ করানো যাচ্ছে না। দলে মোদী-অমিত শাহের কর্তৃত্বের রাশ দুর্বল হয়েছে কি না, সে প্রশ্নও উঠে গিয়েছে। যাতে ইন্ধন দিয়েছেন আডবাণী। অন্য দিকে সুষমা বিতর্কে মুখে কুলুপ এঁটেছেন মোদী। বিরোধীদের মতে, এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে সুষমার বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করার ক্ষমতা নেই মোদীর।
প্রধানমন্ত্রী ললিত মোদী কাণ্ডে মুখ না খুললেও এখনও পর্যন্ত বসুন্ধরাকে সমর্থন করার কোনও ইঙ্গিত দেয়নি দল। বিজেপির বক্তব্য, এ বিষয়ে যা বলার তা রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীই বলবেন। এই পরিস্থিতিতে কাল পঞ্জাব যাচ্ছেন অমিত শাহ ও রাজনাথ সিংহ।
সেখানে থাকার কথা বসুন্ধরার। এখন দেখার, বসুন্ধরা সেখানে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করে বরফ গলাতে পারেন কি না।