National news

ট্রেনে ঘেন্না করছিলেন সবাই, কেউ বোঝেননি আসলে ইনি...

হঠাৎ কানের কাছে চিৎকার শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। আমার সামনের সিটে তখন ‘পাগলে-মানুষে’ টানাটানি।

Advertisement

বিদীপ্তা বিশ্বাস

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৮ ১৮:৫৪
Share:

মুম্বই লোকালের ওই বৃদ্ধার সঙ্গে তরুণী।

সে দিন নাইট ডিউটি করে অফিস থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। উঠেছিলাম সোনারপুর থেকে ক্যানিং লোকালে।

Advertisement

সারা রাত কাজ করে শরীর বেশ অবসন্ন! সকালের দিকে ডাউন ট্রেনগুলো ফাঁকাই থাকে। তাই বেশ নিশ্চিন্তেই ঘুমানো যায়। আমিও সে দিন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

হঠাৎ কানের কাছে চিৎকার শুনে ঘুমটা ভেঙে গেল। আমার সামনের সিটে তখন ‘পাগলে-মানুষে’ টানাটানি। সিটে বসে থাকা এক ‘পাগল’ মহিলাকে দরজার কাছে মেঝেতে গিয়ে বসতে বলছেন কয়েক জন মহিলা যাত্রী!

Advertisement

গায়ে নোংরা, ফুটিফাটা পোশাক জড়ানো এক বয়স্ক মহিলা। উস্কোখুস্কো, অবিন্যস্ত চুল। কথায় আর যুক্তিতে কিন্তু তিনি অনেককেই হার মানাবেন। ঠিক যতটা হেয় সুরে, গলা চড়িয়ে তাঁকে নীচে নেমে বসার জন্য জোরাজুরি করছিলেন যাত্রীরা, তিনি ঠিক ততটাই নাছোড়বান্দা।

আরও পড়ুন: ইউটিউব ভিডিও দেখে বাড়িতে প্রসব করালেন স্বামী, মর্মান্তিক মৃত্যু স্ত্রীর

কেন সিট থেকে তাঁকে নামতে হবে? তাঁর ‘অপরাধ’ কী?

ট্রেন তো সকলের! এবং তাঁরও যে কোনও সিটে বসার অধিকার আছে... ওই মহিলার মুখে এমন দৃঢ় এবং স্পষ্ট কথা শুনে রীতিমতো থ হয়ে গিয়েছিলেন যাত্রীরা। কোনও অবান্তর যুক্তি তিনি দেননি। তাই তাঁর বিপক্ষে কেউ একটা কথাও বলতে পারেননি সে দিন। বাকি রাস্তাটা নিজের আসনে বসেই গিয়েছিলেন ওই মহিলা। কয়েকটা স্টেশন পরে থলিটা হাতে তুলে চুপচাপ নেমে পড়েন ট্রেন থেকে।

‘পাগল’ আবার এমন করে কথা বলতে পারে নাকি? সে দিন অন্য যাত্রীদের মতো বিস্মিত হয়েছিলাম আমিও। মুম্বইয়ে বিরারগামী লোকালের একটা ঘটনা ফের সেই মহিলার কথা মনে করিয়ে দিল। আরও এক বার বিস্ময়ে ভরিয়ে ফেলল মনটাকেও।

আরও পড়ুন: ‘তিন-চারটে বিয়ে, আট-দশটা সন্তান, মুসলিমরা এক দিন নতুন রাষ্ট্র দাবি করবে’

বুধবার মুম্বই লোকালে চেপে চার্চগেট থেকে বিরার যাচ্ছিলেন এক তরুণী। সেই ট্রেনে কামরার এক পাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন মলিন পোশাক পরা এক বৃদ্ধা। এতটাই মলিন তিনি যে, তাঁর দিকে আড় চোখে তাকাচ্ছিলেন আশপাশের যাত্রীরা। প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে ওই মহিলার থেকে দূরত্ব রেখেই দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। গায়ে যাতে স্পর্শ লেগে না যায়! সঙ্গে উড়ে আসছিল অসম্মানজনক, কটূ মন্তব্য। কোনও প্রতিবাদ ছিল না। কোনও খারাপ লাগাও ছিল না তাঁর মুখে। খানিকটা অভ্যস্থ ভঙ্গিতেই ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

অসহায় বৃদ্ধাকে ও ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে ওই তরুণী তাঁকে বসার জায়গা করে দিতে অনুরোধ করেন। বৃদ্ধা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার সামনের আসনে বসা যাত্রীদের একটু চেপে বসতে বলেন তিনি। ওই তরুণী টুইটারে লিখেছেন, বৃদ্ধা এতটাই শীর্ণ ছিলেন যে, তিনি মাত্র ২-৩ বছরের একটা বাচ্চার বসার মতো জায়গা পেলেই বসতে পারতেন। কিন্তু পরিষ্কার-ঝকঝকে-ইস্ত্রি করা টানটান পোশাকে পাছে ‘দাগ’ লেগে যায়, তাই এ রকম এক জন অপরিচ্ছন্ন মহিলাকে বসতে দিতে নারাজ ছিলেন যাত্রীরা। শেষমেশ ওই তরুণী নিজের পাশেই বৃদ্ধার বসার ব্যবস্থা করেন।

তরুণী এতটাই বিস্মিত হয়েছিলেন যে, পরে তিনি টুইট করে সে দিনের সেই ঘটনা শেয়ার করেন। তবে বিস্ময়টা শুধু একদল ঝকঝকে পোশাক পরা মানুষের এক জন মলিন পোশাক পরা মানুষের প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য নয়। তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন ওই বৃদ্ধার জীবনের গল্প শুনে। বৃদ্ধা তরুণীকে জানান, তাঁর নাম আইভি। একটা সময়ে তিনি রাজ্য স্তরে হকি খেলেছেন! যৌবনে পার্ট টাইম মডেলিংও করেছেন। এমনকি, ভারতে অবস্থিত ফরাসি দূতাবাসে দোভাষীর কাজও করেছেন।

গড়গড় করে তরুণীকে জীবনের গল্প শোনাচ্ছিলেন বৃদ্ধা। অবাক হয়ে সেই কথা শুনছিলেন তরুণী। পরে জানতে চেয়েছিলেন, ওই বৃদ্ধা কেন তাঁর প্রতি সহযাত্রীদের এই অবজ্ঞার প্রতিবাদ করেননি? উত্তরে হেসে বৃদ্ধা তাঁকে জানিয়েছিলেন, ‘‘ওঁদের মন্তব্যগুলো শুধুমাত্র এক ঘণ্টার এই ট্রেনযাত্রায় সীমিত। আমার জীবনের ৬৫টা বছরে বা তার পরে এর কোনও প্রভাব থাকবে না।’’ বৃদ্ধার সঙ্গে সেলফিও তোলেন তরুণী।

একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনটি পড়ে সোনারপুর-ক্যানিং লোকালের সেই বৃদ্ধার কথা মনে পড়ছে বার বার। সত্যিই তো, সারা দিন কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয় আমাদের। তাঁদের কেউ অনর্গল ইংরেজি আওড়ে যান। কারও হাতের দামি মোবাইল আমাদের মনে বিনা কারণেই তাঁদের প্রতি সম্মান বাড়িয়ে তোলে। তাঁরা ঠিক কতটা সম্মানের যোগ্য তা না জেনেই সমীহ করতে শুরু করি।

আর ওই বৃদ্ধা যাঁর দামি মোবাইল নেই, নামী পোশাক পরার সামর্থ নেই অথচ জীবনে গর্ব করার মতো অনেকগুলো গল্প রয়েছে, যে গল্প তাঁকে অন্য অনেকের থেকেই আলাদা করে তোলে— তার খবর না রেখেই অবজ্ঞা করি। কিন্তু অর্থের ঝলকানি বোধহয় সব কিছুই ম্লান করে দেয়। আমরা আসলে মানুষকে নয়, তাঁর অর্থকে সমীহ করতে শিখেছি। কে বলতে পারে, সোনারপুর-ক্যানিং লোকালের ওই বৃদ্ধার জীবনেও হয়তো এ রকম কোনও গল্প রয়েছে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন