বসুন্ধরা প্রসঙ্গ এড়িয়েও মনে করালেন নিজের ইস্তফার কথা

রাজধর্মের খোঁচা লালকৃষ্ণের

নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানোর পরেই সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন লোকসভার তৎকালীন বিরোধী দলনেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী। অভিযোগ-মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনেও না লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি।

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০১৫ ০০:০৩
Share:

নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানোর পরেই সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন লোকসভার তৎকালীন বিরোধী দলনেতা লালকৃষ্ণ আডবাণী। অভিযোগ-মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনেও না লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। রামমন্দির আন্দোলনের পর বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে অটলবিহারী বাজপেয়ীর পাশাপাশি সে সময় তাঁর নামও উঠে আসছিল প্রবল গতিতে। কিন্তু সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দু’বছর নির্বাচন না লড়ে শেষ পর্যন্ত সেই দৌড়ে পিছিয়ে পড়েছিলেন বিজেপির ‘লৌহপুরুষ’।

Advertisement

দু’দশক আগের সেই সিদ্ধান্ত নিয়ে কি কোনও আক্ষেপ আছে? নিজের বাড়িতে মধ্যাহ্নভোজের টেবিলে আনন্দবাজার পত্রিকার তরফে করা এই আচমকা প্রশ্নে মৃদু হেসে প্রবীণ নেতা বললেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতার জীবনে মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতাকে রক্ষা করাই সবথেকে বড় দায়িত্ব। নৈতিকতা কী দাবি করছে, সেটাই রাজধর্ম।’’

সুষমা স্বরাজ-বসুন্ধরা রাজে পর্বের জেরে নৈতিকতার এই প্রশ্নটাই আজ তাড়া করছে বিজেপিকে। সরাসরি না বলেও সে কথাটাই কি বলে দিলেন আডবাণী? সুষমা-বসুন্ধরার ইস্তফার দাবি নিয়ে বিরোধীরা দেশজুড়ে শোরগোল তুলছে। নরেন্দ্র মোদীর সরকার তো বটেই, দল হিসেবেও বিজেপি কিছুটা বেকায়দায়। কিন্তু সে সবের এতটুকু আঁচ যেন লাগছে না বিজেপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের গায়ে! কিন্তু কেন? মুখে কুলুপ আডবাণীর। বাড়ির দক্ষিণী রাঁধুনীর হাতে করা ছোট ছোট ইডলি-সম্বর, লেমন রাইস, দক্ষিণী পাঁপড়ের স্বাদ নিতেই যেন বেশি ব্যস্ত! অথচ হাওয়ালা-কাণ্ডে নাম জড়ানোর পরে নিজেই তো ইস্তফা দিয়েছিলেন। ললিত মোদী-কাণ্ডে জড়িয়ে সুষমা-বসুন্ধরারও কি তাঁর মতোই সরে দাঁড়ানো উচিত? আডবাণীর কথায়, ‘‘এ সব থেকে আজ আমি অনেক দূরে। তাই আমার কোনও মন্তব্য নেই। সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়াতে যেমন আমি নেই, তেমন এ ব্যাপারে আমার কোনও মন্তব্যও নেই।’’ কিন্তু যদি ধরে নিই যে আপনি সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক? মৃদু হেসে প্রবীণ নেতার জবাব, ‘‘তাত্ত্বিক ভাবেও এ রকম একটি বিষয়ের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে আমার ইচ্ছা করছে না।’’

Advertisement

কিন্তু তিনি নিজেই তো উদাহরণ হয়ে উঠেছিলেন। হাওয়ালা-কাণ্ডে ইস্তফা দিয়ে। তা হলে ওই সিদ্ধান্ত কি ভুল হয়েছিল বলে মনে হয় আপনার? ইস্তফা দেওয়া এবং ভোটে না লড়ার ওই সিদ্ধান্তের জন্যই তো আপনি বাজপেয়ীর ১৩ দিনের সরকার এবং ১৩ মাসের সরকারে থাকতে পারেননি? আডবাণীর কথায়, ‘‘যে দিন জৈন ভাইদের ডায়েরির ভিত্তিতে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে, সে দিনই পান্ডারা পার্কের বাড়িতে বসে সিদ্ধান্ত নিই যে, ইস্তফা দেব। সঙ্গে সঙ্গে বাজপেয়ীজিকে জানিয়েছিলাম। তিনি ইস্তফা দিতে বারণ করেন। আমি তাঁর কথাও শুনিনি।’’

হাওয়ালা-কাণ্ডে আডবাণীর নাম জড়ানোর খবরটি যিনি প্রথম তাঁকে দিয়েছিলেন, তিনি সুষমা স্বরাজ। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে আজ তিনি নিজেই ললিত-কাণ্ডে জড়িত! সে দিন আইনজীবী স্বামী স্বরাজ কৌশলের কাছে খবর পেয়ে আডবাণীর কাছে ছুটে এসেছিলেন সুষমা। তার পরেই ইস্তফার সিদ্ধান্ত নেন আডবাণী। কিন্তু কেন? ‘‘বিবেকের ডাকে সে দিন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। বাজপেয়ীজির কথাও শুনিনি। এর জন্য অনুতাপ নেই। রাজনৈতিক নেতার জীবনে বিশ্বাসযোগ্যতা বড় কথা। আমি বারবারই বলি, আমার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শব্দ হল বিশ্বাসযোগ্যতা। আর কেউ না জানুক, আমি জানতাম, টাকাটা আমি নিইনি।’’ একই সঙ্গে বলেন, ‘‘ জানতাম সত্যের জয় হবেই। মানুষ ভোট দিয়ে আমাদের জেতায়। তাই মানুষের কাছে দায়বদ্ধতা হল সবথেকে বড়।’’ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তবে আপনি যে ভাবে ইস্তফা দিয়েছিলেন সেটাই কি আচরণবিধি হওয়া উচিত? আগের মতোই নিরুত্তাপ থেকে আডবাণীর জবাব, ‘‘আমি আমার কথা বলতে পারি। অন্যরা কে কী করবেন, কার কী বিষয়, কী সমস্যা, আমি জানি না। আর এ সব বিষয়ে কোনও মন্তব্য করব না।’’

কথায় কথায় নিজেই জানালেন, রাজনীতি করতে গিয়ে দুর্নীতির আঁচ যাতে গায়ে না লাগে, সে জন্য আগাগোড়া সতর্ক থেকেছেন। বস্তুত ঘুষ নিতে ধরা পড়া দলিত নেতা তথা বিজেপির তৎকালীন সভাপতি বঙ্গারু লক্ষ্মণ বা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়া তৎকালীন কেন্দ্রীয় ভূতল পরিবহণমন্ত্রী এস আর মুথাইয়াদের সরাতে সবচেয়ে বেশি তৎপর হয়েছিলেন আডবাণীই। তাঁর নিজের কথায়, ‘‘জনসঙ্ঘের আমল থেকে, এমনকী তারও আগে আরএসএসের শাখায় আমাদের শেখানো হয়েছিল, সততাই সবচেয়ে বড় মানবিক গুণ। দুর্নীতির প্রশ্নে আমরা যেন কোনও আপস না করি।’’ এই প্রসঙ্গেই উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘‘দলের যখন নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছিল, তখন গুরুজি (এম এস গোলওয়ালকর) বলেছিলেন, সংগঠনের জন্য দলীয় দফতর তৈরি করতে একটু দ্বিধাগ্রস্ত হই। কেন না বাড়ি বানাতে গেলে টাকা লাগবে। চাঁদা তুলে তা সংগ্রহ করতে হবে সদস্যদের। ভয় লাগে, এ সব করতে গিয়ে দলে দুর্নীতি না ঢুকে পড়ে!’’

কিন্তু দুর্নীতি তো এড়ানো যায়নি! দু’দশক আগে ‘আপনি আচরি ধর্মের’ উদাহরণ হয়ে সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। সুষমা-বসুন্ধরারা কি সেই পথ নেবেন? এটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন