লুট হয়েছে সব! আত্মহত্যা করার আগে লিখেছিলেন চাষি

রক্তাক্ত পায়ে কৃষকের লং মার্চ কাঁপিয়ে দিয়েছে দেশকে। অব্যাহত আত্মহত্যা। খরা, ঋণের বোঝা, ফড়ের দাপট নিয়ে কেমন আছেন কৃষকেরা?সর্ষের সোনালি আর তরমুজের সবুজ নিজেদের মধ্যে দিব্যি কাটাকুটি খেলছে। বোঝা মুশকিল যে এই বিস্তীর্ণ খেতের মধ্যে লুকিয়ে রক্তের দাগ। যেখানে পোকা হয়ে মিশে রয়েছে চাপা আতঙ্ক। কোনায় একলা আমগাছটি। দু’সপ্তাহও হয়নি, ভোররাতে এই গাছে দড়ি় দিয়ে ঝুলেছিলেন আলু-চাষি সুভাষচন্দ্র পাল। 

Advertisement

অগ্নি রায়

কনৌজ শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:৪০
Share:

আত্মঘাতী সুভাষের মা রামবতী।

সর্ষের সোনালি আর তরমুজের সবুজ নিজেদের মধ্যে দিব্যি কাটাকুটি খেলছে। বোঝা মুশকিল যে এই বিস্তীর্ণ খেতের মধ্যে লুকিয়ে রক্তের দাগ। যেখানে পোকা হয়ে মিশে রয়েছে চাপা আতঙ্ক। কোনায় একলা আমগাছটি। দু’সপ্তাহও হয়নি, ভোররাতে এই গাছে দড়ি় দিয়ে ঝুলেছিলেন আলু-চাষি সুভাষচন্দ্র পাল।

Advertisement

উত্তরপ্রদেশের এই গাঁয়ের নাম সিয়ারমাও। সেই ভোরে আমগাছটির দিকে হাঁটা লাগানোর আগে নিজের কাঁচা-পাকা দালানে, খাটিয়ায় ঝুঁকে বসে গোটা রাত বিড়ি ফুঁকেছিলেন বছর পঞ্চাশের সুভাষ। সেটা এখন সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু চওড়া প্লাস্টিক শিট পাতা। যা দেখাচ্ছে নিখাদ শোকমঞ্চের মতো। যেখানে বসে খুব চাপা কিন্তু একটানা স্বরে বিলাপ করে যাচ্ছেন সুভাষের স্ত্রী বিনীতা। আত্মীয়, বন্ধু, প্রতিবেশীরা ঘিরে বসে রয়েছেন গোটা দিন। বোঝাই যাচ্ছে ঘটনার অভিঘাত এখনও টাটকা।

পাঁচতারা, মসৃণ লখনউ এক্সপ্রেসওয়ে থেকে বাঁ দিকে নেমে কিলোমিটার সাতেক গেলে জীর্ণ জি টি রোড। পার হলে দিগন্ত বিস্তৃত আলু, সর্ষে আর তরমুজ খেত। মিনিট কুড়ি যাওয়ার পর সিয়ারমাও। প্রায় তিন হাজার মানুষের প্রাচীন গ্রাম পঞ্চায়েত থমকে রয়েছে গত ক’দিনে জোড়া আত্মহত্যার (দ্বিতীয় আত্মহত্যাকারী কৃষক ব্রজেশ যাদবের বাসস্থান সিয়ারমাও পঞ্চায়েতেরই অন্য গ্রাম ঘাসিপূর্বায়) ধাক্কায়।

Advertisement

আরও খবর: ‘যত ক্ষণ না চাষিদের ঋণ মকুব হচ্ছে, তত দিন মোদীজিকে ঘুমোতে দেব না’

ইন্দির ঠাকরুনের মতো মুখের জ্যামিতি সুভাষচন্দ্রের মা রামবতীর। বিষাদের থেকেও বেশি দাগ ফেলেছে অনিশ্চয়তা। “তিন ছেলের মধ্যে ও-ই তো আমার দেখাশোনা করত। দু’বেলা খাবার, বাতের ওষুধ জোগাড় করত। এখন কী হবে আমাদের?’’ এই প্রশ্নচিহ্ন ঝুলে রয়েছে সুভাষের দুই মেয়ে (একজন বধির ও বাকশক্তিহীন) আর এক ছেলের মুখেও।

আরও পড়ুন: জাত-ধর্মের ভিত্তিতে ক্লাসে বসানো হল স্কুলপড়ুয়াদের!

প্রশ্ন তো রয়েছে, জবাব বিশেষ নেই। সম্পর্কে সুভাষের বড় দাদা শিউকুমার পাল (এঁরা ওবিসি, গাদরিয়া। পশুপালনই আদি জীবিকা) ধীরে ধীরে বলছেন, ‘‘পঞ্চায়েত মুখিয়া একবার ঘুরে গিয়েছে। শুনছি তো মুলায়ম সিংহের ছেলে নাকি বলেছে, পরিবারকে দু’লাখ টাকা দেবে। এই লোকসভা আসন থেকেই তো ওর বৌ জিতেছিল।’’

‘যা কো বিধাতা দুখ দেহি / বাকি মতি পহলে হর লেয়ি’ – সুইসাইড নোটের একদম শেষে দেহাতি লাইন দু’টি লিখেছিলেন সুভাষ। দুঃখ কেন দিলেন বিধাতা আর আগে মতিভ্রংশই বা হল কেন এই মাঝারি মাপের কৃষকটির? বাড়িঘর দেখে তো তাঁকে একেবারে প্রান্তিক বলে মনে হচ্ছে না।

আলু-চাষি সুভাষচন্দ্রের বাড়ির উঠোনে পরিজনেরা। নিজস্ব চিত্র

‘‘কোনও ধারদেনা ছিল না ওর, যতদূর আমরা জানি।’’ সমস্বরে জানাচ্ছে উৎসুক ভিড়। ‘‘নোট বাতিলের পরই ওর মাজা ভেঙে যায়।’’ ‘গুনগনা’ (উষ্ণ) জল একটু একটু করে চুমুক দিচ্ছেন সুভাষের বৃদ্ধ কাকা। থাকেন ফারুকাবাদে। খবর পেয়ে এসে আছেন ক’দিন। সুভাষের লেখা যে সুইসাইড নোটটি পুলিশ জমা করে নিয়েছে (কোনও অভিযোগ দায়ের করেনি এখনও পর্যন্ত), তার শুরুতেই রয়েছে নোটবাতিলের প্রসঙ্গ।

সুইসাইড নোট? নাকি একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন? গলায় দড়ি দেওয়ার আগে সুভাষ লিখছেন, ‘সঞ্চিত প্রায় সব গিয়েছে নোটবন্দিতে। এরপর লিলি কোল্ড আমার সব ফলন নিয়েছে, ভুসি নিয়েছে। কিন্তু দামে মেরে দিয়েছে। বছরের পর বছর। এখন আর না পেরে প্রতিবাদ করায়, ভয় দেখাচ্ছে মাঝরাতে ফোন করে। যশোদা কোল্ডের কাছেও গত দু’বারের ফসল বেচেছি, খুব কম দামে। আর পয়সা অবশিষ্ট নেই নতুন করে চাষ করার। এমন জীবন রেখে লাভ নেই। সব লুট হয়ে গিয়েছে। তাই মজবুর হয়ে আত্মহত্যার পথই বেছে নিলাম।’

যশোদা কোল্ডের মালিক সমীর পাঠক অবশ্য ‘সবিনয়ে’ জানিয়ে দেন, তাঁরা কোনও চাপই দেননি সুভাষকে। ‘‘ও ঠিক সময়ে বিক্রি না করে আমাদের স্টোরেজে আলু রেখেছিল। ভেবেছিল, দিওয়ালির সময়ে বেচবে। কিন্তু দিওয়ালির সময় নতুন আলু ওঠে। পুরনো আলুর দাম পাবে কী করে? নিজের দোষেই মরেছে। আমাদের দোষ নেই। দেখুন না, আলু বিক্রি না হলে ভাড়াও পাই না আমরা। সুভাষও ভাড়া দেয়নি। কিছু কি বলেছি?’’

এই বলা-না-বলার ধোঁয়াশাটা মারাত্মক। নইলে কেনই বা এখানকার কৃষকদের মুখচলতি এক শীতল আতঙ্কের নাম ‘কোল্ড’!

এই জেলায় যে ১১১টি ‘কোল্ড স্টোরেজ’ রয়েছে, সেগুলি মূলত চালান উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণরা। ক্ষমতাসীন রাজ্য সরকারের আশীর্বাদ নিয়ে। স্থানীয় কৃষক পরিবারগুলির বক্তব্য, কোল্ড আদতে একটি তেল খাওয়া মাফিয়া মেশিনের মতো। যার অধীনে স্থানীয় বাহুবলী, ফড়ে, দালাল। অভিযোগ, যোগী আদিত্যনাথের সময়ে এদের রমরমা বেড়েছে বহুগুণ। এদের লম্বা হাত কনৌজ শহর, কানপুর হয়ে গোটা দেশের বড় বড় মান্ডিতেই। এরা আলু-অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে খেত-এজেন্টদের মাধ্যমে।

একটি বিদেশি সংস্থার তরফে স্থানীয় কৃষকদের ‘জমিনি’ হকিকত নিয়ে পরামর্শ দেন কৃষি-অর্থনীতির পেশাদার প্রদীপ কুমার। বলছেন, ‘‘কোল্ড যদি আতঙ্কের একটি দিক হয় তাহলে এই খেত–এজেন্টরা অন্যদিক।’’ আলুর কোনও ন্যূনতম বা সর্বোচ্চ বিক্রয়মূল্য

কৃষকদের জন্য সরকার বেঁধে দেয়নি। ফলে খোসা ছাড়িয়ে আলু খেয়ে নিচ্ছে এই এজেন্ট-বুলবুলিরা! প্রদীপের কথায়, ‘‘প্রধানত আলু, তার সঙ্গে সর্ষে, ভুট্টা জমিতে বপন করা হয় সেপ্টেম্বরে। ডিসেম্বরে একদফা কাঁচা আলু তুলে নেওয়া হয়, যেগুলির আয়ু খুব কম। ফলে কোল্ড স্টোরেজে দেওয়া যায় না। এক সপ্তাহের মধ্যে বিক্রি করে দিতে হয়। যে আংশিক ফাঁকা জমি (৩০ শতাংশ) এর ফলে তৈরি হয়, সেখানে গমের বীজ বুনে দেন চাষিরা। গম আর আলুর জন্য প্রস্তুতি, কীটনাশক একই বলে সুযোগটা নেওয়া হয়। মার্চ মাসে একই সঙ্গে ৭০ শতাংশ আলু এবং গম গোলাজাত করা হয়। এই বিপুল আলু কৃষকেরা পাঠান কোল্ড স্টোরেজে।’’

কিন্তু খেত উপচানো ফসলকে কোল্ড স্টোরেজ বা সেই অর্থে দেশের বিভিন্ন বড় মান্ডিতে পৌঁছনোর যে রাস্তা, সেখানেই বাহুবলী-কমিশন এজেন্ট এবং কোল্ড মালিকদের ত্রিমুখী আক্রমণ। কারণ, সরকার কোনও দাম বেঁধে দেয়নি। ফলে ছোট বড় লরি, টেম্পো, ম্যাটাডর নিয়ে ঝোপ বুঝে কোপ মারার জন্য ওত পেতে থাকেন এজেন্টরা। কৃষক বেদরাম যাদবের কথায়, ‘‘ফসল তোলার মরসুমে খেতের ধারে তাঁবু খাটিয়ে অপেক্ষা করে এজেন্টরা। ফসল নিয়ে দূরদূরান্তে সওদা করতে যাওয়ার রসদ কি আমাদের আছে? তাই এদের উপরেই নির্ভর করতে হয়। এরা ইচ্ছেমতো দর হাঁকে।’’ জানা গেল, অন্তত ২০ শতাংশ কমিশন রেখে এজেন্টরা আলুর মূল্য নির্ধারণ করেন। কখনও বা তা আরও বেশি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন