দু’ঘণ্টায় ৭ কম্পন

নেপালে ফের কম্পনে কাঁপুনি বঙ্গের বুকেও

ছন্দে ফেরার মুখেই ছন্দপতন। মঙ্গলবারের ব্যস্ত দুপুর। ভারতীয় সময়, ১২টা ৩৫। কাঠমান্ডুর ঠান্ডা অফিসঘরে তখন জরুরি বৈঠকে ব্যস্ত দেশের এক নামজাদা বাণিজ্যিক সংস্থার প্রধান শিবানী নিওপানে। গত মাসের ভূমিকম্পে সিন্ধুপালচকে সম্পূর্ণ ধসে যাওয়া একটা গ্রামকে কী ভাবে ঢেলে সাজা যায়, তা নিয়েই চলছিল শেষ দফার বৈঠক। হঠাৎ দুলে উঠল চারপাশ।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৫ ০৩:১২
Share:

ফের কেঁপে উঠল নেপাল। আতঙ্কের ছায়া খুদের চোখেমুখে। মঙ্গলবার কাঠমান্ডুতে। ছবি: রয়টার্স।

ছন্দে ফেরার মুখেই ছন্দপতন। মঙ্গলবারের ব্যস্ত দুপুর। ভারতীয় সময়, ১২টা ৩৫। কাঠমান্ডুর ঠান্ডা অফিসঘরে তখন জরুরি বৈঠকে ব্যস্ত দেশের এক নামজাদা বাণিজ্যিক সংস্থার প্রধান শিবানী নিওপানে। গত মাসের ভূমিকম্পে সিন্ধুপালচকে সম্পূর্ণ ধসে যাওয়া একটা গ্রামকে কী ভাবে ঢেলে সাজা যায়, তা নিয়েই চলছিল শেষ দফার বৈঠক। হঠাৎ দুলে উঠল চারপাশ।

Advertisement

এবং মুহূর্তের মধ্যে ফিরে এল সপ্তাহ তিনেক আগের আতঙ্কটা। পড়িমরি করে সিঁড়ি বেয়ে ছ’তলা থেকে নীচে নামলেন শিবানী। তত ক্ষণে প্রায় গোটা কাঠমান্ডু রাস্তায় নেমে এসেছে। পার্লামেন্টে অধিবেশন চলছিল। বক্তৃতা দিচ্ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী সুশীল কৈরালা। বক্তৃতা মাঝপথেই থমকে গেল। হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করলেন এমপি-রা। মাটি তখনও কেঁপেই চলেছে।

২৫ এবং ২৬ এপ্রিলের ভূমিকম্পে এমনিতেই বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল গোটা নেপাল। তার পর থেকে আট হাজার ছাড়িয়েছে মৃতের সংখ্যা। সেই ধ্বংসস্তূপেই আজ ফের ত্রাস ছড়াল নতুন ভূমিকম্প। আগের বারের মতো বিধ্বংসী না হলেও আজকের ভূমিকম্পে নেপালে অন্তত ৬৮ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। ভারতে মৃতের সংখ্যা ১৭। তাঁদের মধ্যে ১২ জনই বিহারের। ভরদুপুরে দুলে উঠে ফের আতঙ্কনগরী কলকাতাও। উত্তরবঙ্গে আহত বেশ কয়েক জন।

Advertisement

রিখটার স্কেল বলছে, আজকের ভূমিকম্পের তীব্রতা ২৫ এপ্রিলের চেয়ে মাত্র ০.৬ একক কম। সে দিন ছিল ৭.৯। আজ ৭.৩। মার্কিন ভূতাত্ত্বিক সংস্থার (ইউএসজিএস) দাবি, আজকের ভূকম্পের উৎসস্থল ছিল কাঠমান্ডু থেকে প্রায় ৮৩ কিলোমিটার পূর্বে, নেপাল-চিন সীমান্তের ঝাম-এ। উৎসস্থল মাটির সাড়ে ১৮ কিলোমিটার গভীরে। এ বারও কম্পনের জন্য দায়ী ভূস্তরের নীচে ভারতীয় ও ইউরেশীয় পাতের ঠোকাঠুকি। যার জেরে পরের দু’ঘণ্টায় অন্তত ন’টি ‘আফটার-শক’ অনুভূত হয়েছে। আফগানিস্তানেও একটি ভূমিকম্প হয়েছে এ দিন। যার তীব্রতা ছিল ৬.৯। মার্কিন ভূতত্ত্ববিদদের একাংশ এ দিনের কম্পনগুলিকে ২৫ এপ্রিলের ‘আফটার-শক’ বললেও ভারতীয় ভূবিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা, নেপালে আজ সম্পূর্ণ নতুন একটি ভূমিকম্প হয়েছে।

সেই ভূমিকম্পের ধাক্কায় নেপালে আজ প্রায় ১২০০ মানুষ আহত হয়েছেন। নতুন করে ভেঙেছে বহু ঘরবাড়ি। ধস নেমেছে বেশ কিছু এলাকায়। প্রশাসন সূত্রে খবর, চৌতারায় বাড়ি চাপা পড়েই চার জনের মৃত্যু হয়েছে। দোলাখা এবং সিন্ধুপালচক জেলাতেই সব চেয়ে বেশি ক্ষতির আশঙ্কা করছে প্রশাসন। কম্পন টের পাওয়া মাত্রই এ দিন বন্ধ করে দেওয়া হয় কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দর। রানওয়েতে ফাটল ধরে যায়। ঘণ্টা দুয়েকের চেষ্টায় তা মেরামতের পর ফের চালু হয় বিমানবন্দর। তবে আগামী কিছু দিন নিয়ন্ত্রিত উড়ান চলবে।

অনেকেই বলছিলেন, এমনিতেই গুঁড়িয়ে যাওয়া দেশটায় আজ আর প্রকৃতি নতুন করে ধ্বংসলীলা চালানোর পর্যাপ্ত রসদ পায়নি। তা না হলে পরিস্থিতি কী হতো, বলা যায় না। এপ্রিলের ভূমিকম্পের পর থেকে নেপালে তাঁবুর নীচে দিন কাটছে কয়েক হাজার ঘরছাড়ার। ত্রাণ নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে। রয়েছে কালোবাজারির অভিযোগও। কয়েকশো লোক এখনও নিখোঁজ। ধ্বংসস্তূপের নীচ থেকে আর কাউকে জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব নয় বলে সপ্তাহ খানেক আগেই জানিয়ে দিয়েছে প্রশাসন। তবু এ সবের মধ্যেই প্রাণপণে ছন্দে ফিরতে চাইছিল নেপাল। এ দিনের ভূমিকম্প যেন তাতেই ছন্দপতন।

একই রকম ছন্দপতন বিহার-পশ্চিমবঙ্গেও। আগের ভূমিকম্পের পর লড়াইটা ছিল মূলত আতঙ্কের সঙ্গে। ২৫ এপ্রিলের পর এখনও ধাতস্থ হতে পারেননি অনেকে। তাঁদের ক্রমাগত মনে হচ্ছিল, মাটি দুলছে। আজ ফের চাগাড় দিল সেই আতঙ্কই। কলকাতা ও শহরতলির ফ্ল্যাটবাড়ি থেকে অফিসবাড়ি, শপিংমল খালি করে বহু মানুষ নেমে এলেন রাস্তায়। এমনকী শতাধিক সিঁড়ি ভেঙে রাজ্য সচিবালয় ‘নবান্ন’ থেকেও বেরিয়ে এলেন মন্ত্রী-আমলারা। বন্ধ হল মেট্রো। অল্প সময়ের জন্য হলেও ব্যাহত হল বিমান পরিষেবা। ভূমিকম্পের সময়ে শিলিগুড়ি কলেজে চলছিল পার্ট ওয়ানের পরীক্ষা। আতঙ্কিত পরীক্ষার্থীরা কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার পর খোলা মাঠে বসেই পরীক্ষা দিয়েছেন। দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুরের একটি স্কুলে রেলিং পড়ে ভেঙে আহত হয়েছে ১০ ছা়ত্রছাত্রী। উত্তর দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, মালদহতেও একই ধরনের আতঙ্কের ছবি ধরা পড়েছে।

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ঝাড়গ্রামে। তিনি সাংবাদিকদের জানান, রাজ্যের পরিস্থিতি সামাল দিতে স্বরাষ্ট্রসচিবের নেতৃত্বে একটি বিশেষ বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী গঠন করা হয়েছে। খোলা হয়েছে কন্ট্রোল রুম। সরকারি তরফে সব রকমের সাহায্যের আশ্বাস দিয়ে টুইটও করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।

কলকাতার মতোই ভূমিকম্প টের পাওয়া মাত্র মেট্রো পরিষেবা বন্ধ হয়ে যায় দিল্লিতে। উত্তপ্ত অধিবেশনের মাঝে দুলে ওঠে সংসদ ভবন। রাজধানী জুড়েও সেই একই ছবি— ঘরবাড়ি, স্কুল-কলেজ ফাঁকা করে পথে নেমে আসা মানুষ। কম্পন ছড়ায় হিমাচলপ্রদেশ, পঞ্জাব, ছত্তীসগঢ়, তামিলনাড়ু ও গুজরাতেও। জরুরি বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রস্তুত থাকতে বলা হয় জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে (এনডিআরএফ)।

২৫ এপ্রিলের ভূমিকম্পের পর ভারত নিজেই নেপালে গিয়ে ত্রাণ ও উদ্ধারকাজে সামিল হয়েছিল। তবে দিন কয়েক আগেই নেপাল জানিয়েছে, বিদেশি সাহায্যের আর প্রয়োজন নেই। নেপাল ছাড়তে বলা হয়েছে এনডিআরএফ-কেও। তাই সমঝে পা ফেলতে চাইছে নয়াদিল্লি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক সূত্রের কথায়, ‘‘নেপাল যত ক্ষণ না আর্জি জানাচ্ছে, আগ বাড়িয়ে সাহায্য করার প্রশ্নই উঠছে না। ভাল করতে চেয়ে কে আর অপমানিত হতে যাবে বলুন!’’ তবে সাহায্য চেয়ে ডাক এলে ভারত যে এ বারও উদ্ধারকাজে ঝাঁপিয়ে পড়বে, তার ইঙ্গিত মিলেছে। কিন্তু আতঙ্কের হাত থেকে মুক্তি হয়তো এখনই নেই। আগামী কয়েক সপ্তাহ ধরে আফটার শকের সতর্কবার্তা ইতিমধ্যেই শুনিয়ে রেখেছে দিল্লির মৌসম ভবন!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন