বিজয়: লোকসভা ভোটের ফল ঘোষণার পরে দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী। বৃহস্পতিবার। এএফপি
অঝোরে বৃষ্টি পড়ছে। মাথায় ছাতা ধরলেন এসপিজি নিরাপত্তা কর্মী।
রক্ষীকে সরিয়ে বিজেপি দফতরে বৃষ্টিতে ভিজলেন নরেন্দ্র মোদী। চারপাশে তখন ফেটে পড়ছে উচ্ছ্বাস— ‘মোদী-মোদী-মোদী’, ‘জয় শ্রী রাম’। পুষ্পবৃষ্টি হচ্ছে উপর থেকে। সেনাপতি অমিত শাহকে পাশে নিয়ে দু’হাত তুলে দু’হাতে ‘ভিক্টরি সাইন’ দেখালেন প্রধানমন্ত্রী।
জনতা যাঁকে দু’হাত ভরে ভোট দিয়েছে। একাই বিজেপি-কে তিনশো পার করিয়ে দিয়েছে। গত বারের থেকেও এ বারে ঝড়ের বেগ আরও প্রবল। কিন্তু ভোটের সময় ভোটারদের ‘নীরবতা’ ছিল এই ঝড়ের আগেরই স্তব্ধতা। কর্মীদের কাছে বক্তব্য রাখতে গিয়েও মোদী প্রথমে বললেন, ‘‘আজ মেঘরাজাও বিজয় উৎসবে শরিক হয়েছেন। গোটা বিশ্বে ইতিহাস রচনা করেছে ভারতের জনতা। ফকিরের ঝোলা আপনারা ভরে দিয়েছেন। এ জয় ভারতের সব নাগরিকের।’’
গত লোকসভা নির্বাচনে মোদী-ঝড় চোখে দেখা যেত। এ বারে সেটি সে ভাবে খালি চোখে ধরা পড়েনি। কিন্তু নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা গোড়া থেকেই বলে আসছিলেন, বিজেপি এ বার একাই তিনশো পার করবে। ৪৮ বছর পর ইন্দিরা গাঁধীর মতোই আবার কোনও সরকার দ্বিতীয় বার নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে ফিরে আসবে। গত কাল পর্যন্ত বিরোধী শিবিরের কেউ সে কথা মানতে চাননি। এমনকি বুথ ফেরত সমীক্ষার ইঙ্গিতের পরেও। আজ তাই খোদ মোদীই বললেন, ‘‘একবিংশ শতাব্দীতে জনতার মনের মূল্যায়নও বদল করতে হবে।’’
এই ফল এল কী ভাবে?
বিজেপি নেতারা তো বলছেনই, এমনকি কংগ্রেসও বলছে, ‘‘একটাই বড় কারণ। এক দিকে নরেন্দ্র মোদী, অন্য দিকে কে— স্রেফ এই প্রশ্নটিতে হোঁচট খেয়েই আটকে গিয়েছে বিরোধী শিবির। আর বাজি মেরেছেন নরেন্দ্র মোদী।’’ তাঁদের অনেকে এও বলছেন, পুলওয়ামার ঘটনার পর বালাকোটে আক্রমণ না হলে হয়ত মোদী এই ফল নিয়ে আসতে পারতেন না। হাতে গরম জাতীয়তাবাদের তাসটি পেয়ে গিয়েছেন তিনি। মোদীর জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল বলছেন, ‘‘এই জয় জাতীয়তাবাদেরই জয়। নিজের স্বার্থ না দেখে মানুষ দেশের স্বার্থে ভোট দিয়েছেন।’’
আর এই তাসটিই সুকৌশলে খেলে জাতপাতের সমীকরণটিও অনেকটাই মুছে দিতে সমর্থ হয়েছে বিজেপি। মোদী বলেন, ‘‘একবিংশ শতাব্দীতে শুধু দু’টিই জাতি থাকবে। একটি জাতি, যাঁরা দারিদ্র থেকে মুক্তি চাইছেন। দ্বিতীয় জাতি, যাঁরা সেই দারিদ্র মুক্তি দিতে সাহায্য করছেন।’’ বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে মোদী এই ফাঁকে তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও ঝেড়ে ফেলতে চাইলেন। প্রথমত দাবি করলেন, যাঁরা নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ বলে তাঁকে গাল পাড়তেন, তাঁদের মুখ বন্ধ হল। দুই, বিরোধীরা এত জোট বেঁধেও মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে টুঁ শব্দ করতে পারেননি। তিন, তাঁর বিরুদ্ধে নাকি দুর্নীতির কোনও অভিযোগ কেউ তুলতে পারেননি। এর পর আরও তিনটি প্রতিশ্রুতি দিলেন। তাঁর কাজে ভুল হতে পারে, কিন্তু কোনও খারাপ উদ্দেশে কাজ করবেন না। নিজের জন্য কোনও দিন কিছু করবেন না। আর প্রতিটি মুহূর্ত দেশের জন্য ব্যয় করবেন।
তবে বিরোধী শিবির মানছে, মোদীর সাফল্যের পিছনে তাদের ব্যর্থতাও রয়েছে। প্রথমত, তারা একজোট হতে পারেনি। মোদীর বিরুদ্ধে কাউকে নেতা ঘোষণা করতে পারেনি। উত্তরপ্রদেশের এসপি-বিএসপির জোটে বিজেপির যতটা ক্ষত হয়েছে, সেটা মেরামত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশার মতো রাজ্যে। দক্ষিণেও বিজেপি অনেকটাই থাবা বসাতে পেরেছে। শুধু তামিলনাড়ু-কেরলের মতো রাজ্য এই ঝড়ের মধ্যেও বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো দাঁড়িয়ে।
যোগেন্দ্র যাদবের মতে, ‘‘এই ভোটের তিনটি বড় বিষয়। এক, নরেন্দ্র মোদী জাতীয়তাবাদের মতো বড় বিষয়ে মানুষকে মুগ্ধ করতে পেরেছেন। বিরোধী শিবিরের কেউ এমন কোনও বড় বিষয় তুলতে পারেননি। এতে বেকারত্ব, কৃষি সঙ্কটের মতো মৌলিক বিষয়গুলি হারিয়ে গিয়েছে। সেটাই মোদীর সাফল্য। অতীতে ইন্দিরা গাঁধীও বলতেন, তিনি দারিদ্র হটাও বলছেন, বিরোধীরা ইন্দিরা-হটাও। মোদীও সেই পথ নিয়েছেন। আর নিছক জোট কোনও কাজ করে না।
কর্নাটকই তার উদাহরণ। আর শুধু নেতা কিছু করতে পারে না, যদি না তার পিছনে সংগঠন থাকে। নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে সে কাজটি করেছেন অমিত শাহ।’’ সংগঠনের সঙ্গে মোদীর জনপ্রিয়তার মিশেল ঘটিয়েই বাজি মেরেছে বিজেপি। বিজেপির এক নেতা বলেন, ‘‘অতীতে ‘এমপি’রা ‘পিএম’ নির্বাচন করতেন। এ বারে ‘পিএম’ সব ‘এমপি’ বানালেন।’’ তাঁর বক্তব্য, ভোট হয়েছে শুধু মোদীর নামেই। কেউ মোদীর পক্ষে, কেউ বিপক্ষে। যে কারণে ২০১৪ সালে কংগ্রেসের টিকিটে ৪৪ হাজার ভোট পাওয়া ভোজপুরী অভিনেতা রবি কিষাণ, এ বার গোরক্ষপুরে বিজেপির হয়ে লড়ে সাত লক্ষের বেশি ভোট পেয়েছেন। গোটা দেশে যে ১৮৮টি আসনে কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি লড়াই হয়েছে বিজেপির, সেখানে ১৭৪টিই জিতেছে মোদীর দল।
এই প্রবল জনমতকে ‘বিনম্রতা’র সঙ্গে গ্রহণ করে মোদী আজ বলেন, ‘‘মহাভারতেও যুদ্ধের শেষে কৃষ্ণকে প্রশ্ন করা হয়, তিনি কার পক্ষে? কৃষ্ণ জবাব দেন তিনি হস্তিনাপুরের পক্ষে। আজ ১৩০ কোটি ভারতীয়ও ভারতের পক্ষে ভোট দিয়েছেন। বিজেপি কখনও দু’টি আসন পেয়েছে। আজ যখন ‘দো সে দোবারা’ হল, তখনও বিজেপি আদর্শ, সংস্কার থেকে পথভ্রষ্ট হয়নি। মানুষ যে ভরসা রেখেছেন, তাতে আমাদের দায়িত্ব আরও বাড়ল।’’