দু’টি পৃথক ঘটনায় অন্ধবিশ্বাসের বলি হয়ে প্রাণ হারালেন দুই বৃদ্ধা ও এক শিশুকন্যা। একটি ঘটনায়, সামান্য মোবাইল ফোন খুঁজে বের করতে বলি দেওয়া হল একটি শিশুকে। অন্য ঘটনায়, পরিবারে অসুস্থতা না কাটায় প্রতিবেশী দুই বৃদ্ধাকে জীবন্ত কবর দিল তিন যুবক।
ডাইনি অপবাদে হত্যা ও অত্যাচার রুখতে কড়া আইন চালু হলেও আদিবাসী গ্রামগুলি কুসংস্কার মুক্ত না হওয়ায় পরের পর হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলেছে। এমনকী পুলিশ হত্যাকারীদের গ্রেফতারের পরেও হত্যাকারী ও তাদের পরিবার সগর্বে ঘোষণা করছে, ডাইনিদের মারা কোনও অপরাধই নয়!
প্রথম ঘটনাটি ঘটেছে চড়াইদেও জেলার সোনারিতে। এসপি মোহনীশ মিশ্র জানান, ২৪ অক্টোবর সুসেন গোদবা ও প্রিয়া গোদবার চার বছরের মেয়ে সুনুর নিখোঁজ হওয়ার অভিযোগ থানায় জমা পড়ে। রতনপুর ছ’নম্বর ওয়ার্ডের কাঠনিগাঁওয়ের বাসিন্দা মুকেশ প্রজা নামে এক শ্রমিক গত কাল বিকেলে টিয়ক নদীর পারে জঙ্গলে কাঠ কাটতে গিয়ে সুনুর মুণ্ড ও হাতবিহীন দেহ দেখে গ্রামরক্ষী বাহিনীকে খবর দেন। পুলিশ তদন্ত করে জানতে পারে, কাঠনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে খেলার সময় মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যায় আব্দুল জলিল নামে এক ব্যক্তি।
ঘটনার পিছনে তান্ত্রিকের হাত রয়েছে সন্দেহ করে গ্রামবাসীরা এ দিন ছয় নম্বর ওয়ার্ডে আব্দুল জলিলের ভাই আরিফুদ্দিন আলির বাড়িতে ঘাঁটি গেড়ে থাকা ওঝা, মহম্মদ হক মোল্লা ওরফে দাড়িয়া বাবার ঘরে চড়াও হন। গ্রামবাসীদের জেরায় হক মোল্লা জানায়, কাঠনিগাঁওয়ের হনুমান ভূমিজের মোবাইল চুরি হয়েছিল। তা খুঁজে বের করতে হনুমানের বাড়িতে তন্ত্রসাধনার আয়োজন করা হয়েছিল। মোবাইলের সন্ধান করতে হলে শিশুর রক্ত চাই বলে জানায় হক মোল্লা। আব্দুল জলিল সুনুকে তুলে আনে। তাকে জঙ্গলে বলি দেওয়া হয়। তবে পুলিশ আসার আগেই গ্রামবাসীদের হাত ছাড়িয়ে ওই ওঝা পালিয়ে যায়। আরিফুদ্দিন ও হনুমানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। হক মোল্লা ও আব্দুল জলিলের সন্ধান চলছে। সুনুর দেহ ময়নাতদন্তে পাঠানো হয়েছে।
অন্য দিকে, নগাঁও জেলার সামাগুড়ি এলাকায় আদিবাসী পরিবারের অন্ধবিশ্বাসের বলি হলেন দুই বৃদ্ধা। পুলিশ জানায়, পুরনিগুদাম এলাকার চার নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা দু’টি পরিবারের মধ্যে দীর্ঘদিনের রেষারেষি ছিল। গত রাতে বাসু গৌড়, কুমার শানু ও শানু গৌড় নামে তিন যুবক পাশের বাড়িতে থাকা দুই বৃদ্ধা, সালমি গৌড় ও সাগ গৌড়ের উপরে চড়াও হয়। বৃদ্ধাদের মারধর করে কাঁচা কুয়োয় জীবন্ত সমাধি দেয় তারা। খবর পেয়ে গ্রামরক্ষীরা পুলিশ নিয়ে আজ সকালে ঘটনাস্থলে হাজির হয়। কুমার শানু পালালেও বাসু ও শানু গৌড় সগর্বে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করে, ওই দুই বৃদ্ধা ডাইনি বিদ্যা চর্চা করত। তাঁদের কুমন্ত্রের ফলেই বাসুদের পরিবারে মহিলাদের অসুস্থতা যাচ্ছিল না। এমন নৃশংস খুনের ঘটনায় যুক্তদের মা, স্ত্রী, বৌদিদের চোখমুখেও কোনও অনুশোচনা বা ভয়ের চিহ্ন ছিল না। তাঁরা সংবাদমাধ্যমে স্পষ্ট জানান, গ্রামের এক ওঝা ও মন্দিরের এক পুজারি তাঁদের জানিয়েছিলেন দুই বৃদ্ধা ডাইনি মন্ত্র দেওয়াতেই পরিবারের অমঙ্গল হচ্ছে। অনেক বোঝানোর পরেও দুই বৃদ্ধা তন্ত্রসাধনা ছাড়েননি। তাই পরিবার ও গ্রামের মঙ্গলের স্বার্থে বাড়ির ছেলেরা উচিত কাজই করেছে। পুলিশ ওঝা ও পূজারিকেও খুঁজছে।
ডাইনি অপবাদে হত্যা ও অত্যাচারের ঘটনা রুখতে গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে কড়া আইন এনেছে অসম। ২০১৫ সালে ওই বিল বিধানসভায় সর্বসম্মত ভাবে পাশ হলেও গত এক বছরে তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায়নি। তাই বিল পাশ হলেও তার রূপায়ণ আটকে রয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক বিলের চার-পাঁচটি অংশ পরিমার্জনের সুপারিশ করেছে। তার জন্য ফের বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করে খসড়া ঢেলে সাজছে সরকার।
পুলিশ কর্তাদের মতে, আইন হলেও মানুষের মন থেকে অন্ধবিশ্বাস না গেলে ডাইনি অপবাদে হত্যা ঠেকানো যাবে না। কড়া আইন মানুষের মনে ভয় সৃষ্টি করে, অন্যায় করা থেকে তাদের বিরত রাখে। কিন্তু অসমের আদিবাসী এলাকায় শিশুবলি, নরবলির যে সব ঘটনা ঘটছে, তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হত্যাকারী বা গ্রামের মানুষ ঘটনাটিকে অপরাধ বলে গণ্যই করছে না। হত্যাকারী বা হত্যায় প্ররোচনা দেওয়া ওঝা-তান্ত্রিকদের গ্রেফতার করতে গেলে গণরোষের মুখে পড়ছে পুলিশ। রাজ্য সরকার ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আদিবাসী, চা-জনগোষ্ঠী অধ্যূষিত গ্রাম ও বড়োভূমিতে জনচেতনা বাড়ানোর জন্য সচেতনতা সভা করছে। গ্রামরক্ষীবাহিনীকে অতিরিক্ত সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।