হিমন্তের বাজেটে ‘ব্রাত্য’ বরাক

উপনিষদ থেকে স্বামী বিবেকানন্দের বার্তা, রবীন্দ্রনাথ থেকে নলিনীবালা দেবীর কবিতা আর গাঁধীজির আদর্শের কথা উল্লেখ করে সর্বানন্দ সোনোয়াল সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০১:৪৩
Share:

রাজ্য বাজেট পেশের আগে মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালের সঙ্গে অসমের অর্থমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা। মঙ্গলবার গুয়াহাটিতে। ছবি :পীতাম্বর নেয়ার।

উপনিষদ থেকে স্বামী বিবেকানন্দের বার্তা, রবীন্দ্রনাথ থেকে নলিনীবালা দেবীর কবিতা আর গাঁধীজির আদর্শের কথা উল্লেখ করে সর্বানন্দ সোনোয়াল সরকারের প্রথম পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করলেন অর্থমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মা।

Advertisement

পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতকে বাদ রেখেই তৈরি হল বাজেট। ২৩৪৯.৭৯ কোটি টাকার ঘাটতি বাজেটে রাজ্যের পরিকাঠামো, কৃষি, মহিলা ও যুব সম্প্রদায়ের বিকাশ এবং প্রতিবন্ধী কল্যাণে দেওয়া হয়েছে সব চেয়ে বেশি গুরুত্ব। নতুন করে কোনও কর চাপানো হয়নি। কিন্তু বরাকবাসীর জন্য বাজেটে তেমন কোনও ঘোষণা নেই। বিস্তর প্রতিশ্রুতির পরও করিমগঞ্জ পেল না মেডিক্যাল কলেজ। বরাকের বিজেপি বিধায়কদের চাপে শেষ পর্যন্ত পরের বাজেটে করিমগঞ্জে মেডিক্যাল কলেজের প্রতিশ্রুতি দেন হিমন্ত। তিনি জানান, অনুকম্পামূলক নিযুক্তি প্রথা বন্ধ হবে। অসমীয়া সিনেমাকে উৎসাহ দিতে বাজেটে বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা ঘোষণা করা হয়। বাজেট ভাষণের শুরু ও শেষ নয়, মধ্যেও কবিতার উদ্ধৃতি দিয়েছেন হিমন্ত।

বিরোধীদের অভিযোগ, এ বারের বাজেটে সাহিত্য থাকলেও নেই অর্থনীতি, বাস্তবতা। অর্থমন্ত্রী জানান, বিজেপির ‘ভিশন ডকুমেন্টে’র প্রতিশ্রুতি মাথায় রেখেই তৈরি হয়েছে বাজেট। বাজেট তৈরির আগে সব বিধায়কের মতামত নেওয়া হয়েছে। তাঁদের দাবিগুলিকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে।

Advertisement

বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭০ হাজার ৭১৯ কোটি ৬১ লক্ষ টাকা। পরিকল্পনা বিভাগের নতুন নাম হবে ‘অসম উন্নয়ন ও রূপান্তরণ বিভাগ’। পরিকল্পনা বোর্ডের নতুন নাম হচ্ছে ‘রাজ্য উদ্ভাবন ও রূপান্তরণ আয়োগ’।

বাজেটে শিলচর, তিনসুকিয়া, যোরহাট, ডিব্রুগড়, নগাঁও ও তেজপুর শহরের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য শহরপ্রতি ২০০ কোটি টাকা করে মোট ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। গুয়াহাটির পানবাজার থেকে উত্তর গুয়াহাটি এবং পলাশবাড়ি থেকে শুয়ালকুচি পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের উপরে হবে সেতু। তার জন্য আন্তর্জাতিক টেন্ডার ডাকা হচ্ছে। এ বারের বাজেটে বরাদ্দ হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। কুরুয়া থেকে নারংগি পর্যন্ত ব্রহ্মপুত্রের উপরে ছয় লেনের সেতু ও চাংসারি থেকে কুরুয়া পর্যন্ত চার লেনের রাস্তা গড়ার প্রস্তাব আছে বাজেটে। শিলচরের তারাপুরে রঙিরখারি থেকে প্রেমটোলা হয়ে শিলচর স্টেশন সংযোগকারী উড়ালপুল তৈরি হবে। শিলচরে তৈরি হবে তারামণ্ডল। চলতি বছর জুলইয়ের মধ্যে দক্ষিণ ও উত্তর গুয়াহাটির রোপওয়ের কাজ শেষ হবে। পানবাজার ও গণেশগুড়িতে হবে আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং। গুয়াহাটির গণেশগুড়িতে বর্তমান উড়ালপুলের উপর দিয়ে জু-রোড থেকে গণেশ মন্দির পর্যন্ত এবং সুপার মার্কেট তিনিয়ালিতে উড়ালপুল তৈরি হবে। ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজ্যে ১ হাজার কাঠের সেতু পাকা করা হবে।

হিমন্ত জানিয়েছেন, দেশের মধ্যে প্রথম রাজ্য হিসেবে অসমে কৃষকদের এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত বিনা সুদে ঋণ দেওয়া হবে। ২০১৮ সালের মধ্যে ৫০০ হেক্টর সরকারি জমি, ২ হাজার হেক্টর পতিত জমি ও ৮ হাজার হেক্টর ব্যক্তিগত জমিতে মুগা চাষ শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য।

চা বাগানের কর্মীদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ৫ হাজার টাকা করে জমা দেবে রাজ্য। তার জন্য বরাদ্দ হয়েছে ২৮৭ কোটি টাকা। গর্ভবতী চা কর্মীদের ১২ হাজার টাকার এককালীন সাহায্য দেওয়া হবে। ৩২০টি অনগ্রসর বাগানে ভ্রাম্যমাণ চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়া হবে। বাগান এলাকার ১০০টি স্কুলকে হাইস্কুল করা হবে। কাঁচা চা পাতার উপরে উপকর কমিয়ে প্রতি কিলোগ্রামে ১০ পয়সা করা হয়েছে।

গুয়াহাটি, ডিব্রুগড়, শুয়ালকুচি, রঙাপাড়া, যোরহাটে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকার জন্য দু’টি প্রকল্প নিচ্ছে রাজ্য। পর্যটকদের সুবিধার্থে কামাখ্যা, কাজিরাঙা, মাজুলি, তেজপুর, শুয়ালকুচি, মানস ও পবিতরায় ২৪ ঘণ্টার ফিডার লাইন বাবদ ৩০ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। পর্যটকদের জন্য হোম স্টে গড়লে সরকারকে বিলাসকর দিতে হবে না।

প্রতিবন্ধীদের চিকিৎসার জন্য দীনদয়াল দিব্যাঙ্গ সাহায্য প্রকল্পের অধীনে রাজ্যের সাড়ে চার লক্ষ প্রতিবন্ধীকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হবে। দু’টি উচ্চশিক্ষাকেন্দ্র গড়া হবে মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য। কর্মরত মহিলাদের আবাসের জন্য খরচ হবে ৮ কোটি টাকা। সাংবাদিকদের দেওয়া হবে পেনশন। পুলিশের শূন্য পদে নিযুক্ত হবেন ৮ হাজার ৯৯৩ জন। আরও দু’টি রিজার্ভ ব্যাটালিয়ন তৈরি হবে। দেরগাঁও পুলিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে আন্তর্জাতিক মানের পুলিশ অ্যাকাডেমি হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ১০টি জেলায় চালু হবে ই-চালান। উমরাংশুকে পুলিশ মহকুমা গড়া হবে। বাড়ল গ্রামরক্ষী বাহিনীর হাতখরচ।

অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, খাদি ও স্থানীয় বস্ত্রশিল্পকে উৎসাহ দিতে সরকারি দফতরে খাদি পোশাক, খাদির অন্দরসজ্জায় জোর দেওয়া হবে। সরকারি কর্মীদের খাদির পোষাক কেনার জন্য বছরে দু’বার ১ হাজার টাকা দেওয়া হবে। যোরহাট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে দ্বিখণ্ডিত করে পৃথক পশু চিকিৎসা ও জীববিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে রাজ্যের সব দুগ্ধ ও পশু চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানকে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আনা হবে। পুঁটি, দরিকনা, বলিয়রা, খলিহনা, চেলেকানি, বাত, এলেংয়ের মতো রাজ্যে মেলা লুপ্তপ্রায় বা বিপন্ন প্রজাতির মাছ সংরক্ষণে জিন ব্যাঙ্ক গড়বে রাজ্য।

নিত্যপণ্য ও বাজারের সামগ্রীর দাম ওঠা-নামা ক্রেতা-বিক্রেতাদের সমস্যায় ফেলে। তাই রাজ্য সরকার পরিস্থিতিতে ভারসাম্য আনতে ১৫০ কোটি টাকার 'মূল্য স্থিরকরণ পূঁজি' গঠন করছে। ‘উজ্জ্বলা’ প্রকল্পে দরিদ্র পরিবারের মহিলাদের রন্ধন গ্যাসের সংযোগ নেওয়ার জন্য হাজার টাকার সরকারি সাহায্য দেওয়া হবে। কাছাড়, তিনসুকিয়া, হোজাইতে ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ফাস্ট ট্র্যাক আদালত গড়া হবে। কাজিরাঙায় বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত অপরাধের বিচারে গড়া হবে ফাস্ট ট্র্যাক আদালত। হাসপাতালে ভ্রাম্যমাণ এটিএম ও গ্রামে গ্রামে ডিজি ধন মেলার ব্যবস্থা করবে রাজ্য।

রাজ্য সরকার পরম্পরাগত সুরার বাণিজ্যকরণের নীতি নেবে। রাজ্যে আগর চাষে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে। দেশীয় সুরার স্বাস্থ্যসম্মত বটলিংয়ের ব্যবস্থা হবে। অবৈধ সুরা সংক্রান্ত কয়েকটি অপরাধ জামিন অযোগ্য করা হবে। যানবাহনের মূল্য অনুসারে কর আরোপ হবে। পছন্দের নম্বর নিলাম হবে। নতুন রেজিস্ট্রেশন অনলাইনে হবে। স্বামী বিবেকানন্দের নামাঙ্কিত স্বয়ম প্রকল্পে এক লক্ষ যুবককে ব্যবসা করার জন্য এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ দেওয়া হবে। তার মধ্যে ২০% হবে সরকারের ভর্তুকি। ব্যাঙ্কগুলি যাতে নিঃসঙ্কোচে যুবকদের ঋণ দেয় তার জন্য গড়া হবে ১০০ কোটি টাকার রিস্ক ফান্ড। ভর্তুকিবাবদ ২০০ কোটি খরচ ধরেছেন মন্ত্রী। মহিলা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলিকে দেওয়া হবে পাঁচ লক্ষ টাকা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন