কোরান শিক্ষায় ব্যস্ত খুদে।—ফাইল চিত্র।
দিদি পড়ায় ভাগবত গীতা। বোন পড়ায় কোরান।
এক জনের পড়ানোর মাধ্যম খাঁটি সংস্কৃত ও হিন্দি। অন্য জনের ভরসা বিশুদ্ধ আরবি।
দিদি নন্দিনীর ছাত্রছাত্রীরা সকলেই নিন্মবিত্ত হিন্দু পরিবার থেকে আসা। বোন পূজারও ৩৫ জন পড়ুয়ার পরিবার হতদরিদ্র মুসলিম।
অযোধ্যা থেকে দাদরি— গত প্রায় আড়াই দশক ধরে উত্তরপ্রদেশে বারে বারেই রক্তাক্ত হয়েছে সম্প্রীতি। দুই বোনের কল্যাণে সেই রাজ্যেরই একটা কলোনি কী ভাবে যেন হয়ে উঠেছে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রকৃত মুখ।
আগরার কাছে ছোট্ট একটা কলোনি, সঞ্জয়নগর। রোজ সন্ধেবেলা কলোনির একমাত্র মন্দির চত্বরে স্কুল বসে। এলাকার গরিবগুর্বো পরিবারগুলোর বাচ্চাকাচ্চারাই মূলত সেখানে পড়তে আসে। আর সেখানেই পড়ায় ওই দুই বোন। এলাকার মানুষের দুই নয়নের মণি, রানি ও পূজা।
হিন্দু পরিবারের মেয়ে রানি ভাগবত গীতা এবং হিন্দি পড়াবে তাতে তেমন আশ্চর্যের নেই হয়তো। কিন্তু, সেই একই পরিবারের ১৮ বছরের এক কিশোরী অক্ষর, বানান, উচ্চারণ থেকে সব কিছু দিয়েই প্রায় গুলে খেয়েছে আরবি ভাষাকে। প্রতি দিন স্কুল থেকে ফিরে সেই ভাষাতেই মহল্লার মুসলিম বাচ্চাদের কোরান পড়ায় বারো ক্লাসের ছাত্রী পূজা কুশওয়াহা। এলাকায় শিক্ষক হিসাবে তার গ্রহণযোগ্যতা দিদি নন্দিনীর থেকেও বেশি। একে মেয়ে, তার উপর আবার অন্য ধর্মের। তা সত্ত্বেও পূজার উপর অভিভাবকদের অগাধ আস্থা আর ভরসা। পাঁচ বছরের রেশমার মা তো বলেই ফেললেন, ‘‘আমার মেয়ে ওর মতো এক জন শিক্ষিকা পেয়েছে, এটাই অনেক বড় ব্যাপার। পূজার ধর্ম নিয়ে কোনও দিনই মাথা ঘামাইনি। আমার ধারণা, কোনও অভিভাবকই তা ভাবেন না।’’
দাদরির এই মন্দির থেকেই ঘোষণা করা হয়েছিল, আখলাকের বাড়িতে গোমাংস রাখা আছে।
কী ভাবে আরবি ভাষা শিখল পূজা?
এই মহল্লাতেই সঙ্গীতা বেগম নামে এক মহিলা থাকতেন কয়েক বছর আগে। ধর্মের ব্যাপারে তিনিও ভীষণ মুক্তমনা ছিলেন। তাঁর বাবা ছিলেন মুসলমান আর মা হিন্দু। সঙ্গীতা বেগমই এলাকায় বাচ্চাদের কোরান শিক্ষার প্রথম স্কুল খোলেন। অবৈতনিক সেই স্কুলে পূজা যেত। কোরান শিক্ষায় সে উত্সাহী হয়ে পড়ে। এবং দ্রুত শিখতে থাকে আরবি। পূজার কথায়, ‘‘এর পর ব্যক্তিগত কারণে একটা সময়ে আর ক্লাস নিতে পারতেন না সঙ্গীতা বেগম। উনি আমাকে অনুরোধ করেন, আমি যাতে ক্লাস নিই। ওঁর কথা ফেলতে না পেরে আমি রাজি হয়ে যাই। সেই শুরু।’’ সেই ক্লাস এখনও নিয়ে চলেছে পূজাকে।
এলাকায় শিক্ষিকা হিসেবে ‘ছাত্রী’ পূজারই জনপ্রিয়তা বেশি। এর মন্ত্রটা কী?
পূজার কথায়, ‘‘সঙ্গীতা বেগম আমাকে একটা কথা বলেছিলেন। সেটাই মনে রাখার চেষ্টা করি সব সময়।’’ কী সেই কথা? ‘‘জ্ঞান এমনই একটা ব্যাপার, যা তুমি অন্যের সঙ্গে যত শেয়ার করবে, ততই বাড়বে।’’ বেশির ভাগ পড়ুয়া যে হেতু গরিব পরিবার থেকে আসে, তাই পূজা কখনই ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে কোনও টাকাপয়সা নেয় না। সবটাই বিনামূল্যে। দিন দিন তার ক্লাসে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে। বাড়িতে আর জায়গা হয় না। তাই এলাকার প্রবীণেরা কলোনির মন্দির চত্বরটাকেই স্কুল হিসাবে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন তাকে।
পূজা মুসলমান না হয়েও কোরানের চর্চা করে, তা নিয়ে গর্বিত তার পরিবার। দিদি নন্দিনীর কথায়, ‘‘বোন আমাদের সকলের গর্ব। সকলেই ওকে খুব ভালবাসে।’’ একই কথা শোনা গেল এলাকার প্রবীণ এক বাসিন্দার মুখেও। বছর সত্তরের হাজি জামিলুদ্দিন কুরেশি বলেন, ‘‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এ এক অনন্য উদাহরণ। আমাদের রাজ্য এই ভাবনায় শত বিভক্ত। কিন্তু, পূজা তো শিক্ষক। পবিত্র ভাষা জানার ক্ষেত্রে ধর্ম কোনও বিষয়ই নয়। আর ইসলামে কোথাও কাউকে আরবি শিখতে এবং কোরান পড়তে নিষেধ করা হয়নি। ও আমাদের এলাকার গর্ব।’’
১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলা হয়।
আগরা থেকে দাদরির দূরত্ব প্রায় দু’শো কিলোমিটার। অথচ ভাবনাগত ভাবে কত অমিল! বাড়িতে গোমাংস রাখা আছে, এই অভিযোগে গত বছর সেখানে বৃদ্ধ মহম্মদ আখলাককে খুন হতে হয় তাঁরই প্রতিবেশী উগ্র হিন্দু সহনাগরিকদের হাতে। অন্য দিকে, আগরা থেকে অযোধ্যার দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। সেখানে প্রায় ২৪ বছর আগে রাম জন্মভূমির ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে ভেঙে ফেলা হয়েছিল পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন বাবরি মসজিদ। সেই একই রাজ্যের আগরা কিন্তু মানবতার নতুন অধ্যায়ের সন্ধান দিয়েছে। সৌজন্য নন্দিনী ও পূজা কুশওয়াহা।