আশা-নিরাশার দোলায় বরাক-২০১৬

নির্বাচনে রাজ্যের পালাবদলই ২০১৬-র অসমে সব থেকে বড় ঘটনা। রাজ্য পর্যায়ের ঘটনা হলেও এ বারের বিধানসভার নির্বাচন বরাক উপত্যকার রাজনীতিতেও বিরাট প্রভাব ফেলেছে। ২০১১-র ভোটে কংগ্রেস ১৫টি আসনের ১৩টিতেই জিতেছিল।

Advertisement

উত্তম সাহা

শিলচর শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০৩:৩৬
Share:

সর্বানন্দ সোনোয়াল। -ফাইল চিত্র

নির্বাচনে রাজ্যের পালাবদলই ২০১৬-র অসমে সব থেকে বড় ঘটনা। রাজ্য পর্যায়ের ঘটনা হলেও এ বারের বিধানসভার নির্বাচন বরাক উপত্যকার রাজনীতিতেও বিরাট প্রভাব ফেলেছে। ২০১১-র ভোটে কংগ্রেস ১৫টি আসনের ১৩টিতেই জিতেছিল। ৫ বছরের ব্যবধানে তারাই কার্যত ধুয়ে-মুছে সাফ। লক্ষ্মীপুর, বদরপুর ও উত্তর করিমগঞ্জ ছাড়া সর্বত্র কংগ্রেস পরাস্ত। বিজেপি জিতেছে ৮টিতে। আসন বাড়িয়েছে এআইইউডিএফ-ও। হাইলাকান্দির ৩টি আসনের সব ক’টিই তাদের দখলে। জিতেছে দক্ষিণ করিমগঞ্জেও। গৌতম রায়, অজিত সিংহ, সিদ্দেক আহমদ, গিরীন্দ্র মল্লিক—৪ মন্ত্রীর কেউই জিততে পারেননি। শুধু কাছাড়ের কথা বললে, ৭ আসনের ৬টিতেই জিতেছে বিজেপি।

Advertisement

এর ফলে মানুষের প্রত্যাশার পারদ চড়েছে। বিশেষ করে রাস্তাঘাট, শরণার্থীদের নাগরিকত্ব, দুর্নীতি মোকাবিলায় বিজেপির বক্তব্য ভোটারদের আকৃষ্ট করায় আশা জাগে, সেগুলিই অগ্রাধিকার পাবে। ভোটের আগে, ফেব্রুয়ারিতে শিলচরের বিধায়ক দিলীপকুমার পাল রাস্তার দাবিতে অনশনে বসে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে মেডিক্যাল কলেজের আইসিইউ-তে নিয়ে যেতে হয়েছিল। এর ৩ মাসের মধ্যে তাঁরা নিজেরাই ক্ষমতায় এলেন। দিলীপবাবু হয়েছেন বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার। কাছাড়ের পরিমল শুক্লবৈদ্যই রাজ্যের পূর্ত মন্ত্রক পাওয়ায় আশার বেলুনে হাওয়া একটু বেশিই ঢুকে পড়েছে। নতুন বছরের বড় আশঙ্কা, সেই বেলুন না চুপসে যায়!

৭ মাসেও রাস্তাঘাটের হাল ফেরেনি। না জাতীয় সড়কের, না গ্রাম-শহরের। হতাশ বরাকবাসী। শিলচরের মালুগ্রাম, ঘনিয়ালা, ইটখলার বাসিন্দারা রাস্তা সারানোর দাবিতে ২০১৬-র ১০ জানুয়ারি মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন। সেই আন্দোলন বছরভর চলল। ২০১৭-র ১ জানুয়ারি একই ইস্যুতে নাগরিক সভা ডাকা হয়েছে মালুগ্রামে। এর উপর, পরিমলবাবু বরাকে ৮০ শতাংশের বেশি রাস্তা চলাচলযোগ্য বলে আবারও নিজেকে বিতর্কে জড়িয়েছেন।

Advertisement

কিন্তু তাই বলে সাধারণ আমজনতা বিজেপির উপর চরম বীতশ্রদ্ধ, এমনটা বলা যায় না। শরণার্থীদের নাগরিকত্ব ইস্যু আজও ঝুলে রয়েছে। তবু সংসদে বিল এনে শুধু শরণার্থী নয়, অধিকাংশ বাঙালির মনজয়ে অনেকটাই সফল নরেন্দ্র মোদীর দল। এই বিলের মধ্যে দিয়েই আবার নিজের অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখছেন কংগ্রেস সাংসদ সুস্মিতা দেবও। তাঁর দল সোজাসুজি নাগরিকত্বের বিরোধিতায় নামলেও তিনি ভিন্ন অবস্থান গ্রহণ করেছেন।

রাজনৈতিক কৌশলের দরুন বছরটা মন্দ কাটেনি তাঁর। নইলে রাজ্যে সরকারের পতন, কাছাড়-সহ বরাকে দলের খারাপ ফলাফল, মা বীথিকা দেবের টিকিট নিয়ে অতি ঘনিষ্ট তমালকান্তি বণিক ও শৈবাল দত্তের সঙ্গে সংঘাত, এবং শেষ পর্যন্ত মায়ের পরাজয়—এই সব ঘটনার পর তাঁর উঠে দাঁড়ানো মুশকিল বলেই মনে করা হচ্ছিল। কিন্তু তিনি যেমন মানুষের কাছে ছুটে যাচ্ছেন, তেমনই জেলায় দলের রাশ বলতে গেলে পুরো মাত্রায় নিজের মুঠোয় নিয়ে এসেছেন। বাংলা ভাষা নিয়ে রেল প্রতিমন্ত্রী রাজেন গোঁহাই ও বিজেপি বিধায়ক শিলাদিত্য দেবের নানা বিরূপ মন্তব্য তাঁকে বরং বেশি করে মানুষের কাছে যেতে সাহায্যে করেছে। এখনও এনআরসি, ডিটেনশন ক্যাম্প, নাগরিকত্ব, ওআই-এনওআই নিয়ে বিতর্কের অবসান হয়নি।

এই বছরেই নতুন ৪টি মহকুমা পেয়েছে বরাক উপত্যকা। কাছাড়ের কাটিগড়া, করিমগঞ্জের রামকৃষ্ণনগর ও পাথারকান্দি এবং হাইলাকান্দির কাটলিছড়া। পরিকাঠামোগত কাজকর্ম শুরু না হলেও এ নিয়ে ক্ষোভের আশঙ্কা নেই। কারণ ২৫ বছর আগে ঘোষিত লক্ষ্মীপুর মহকুমায় এ বার মহকুমা আদালত শুরু হল। খুলল সাব-ট্রেজারি।

বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অফিসের শূন্যপদ ২০১৬-তেও শূন্যই পড়ে থাকল। বরং তার সংখ্যা বেড়েছে। দূরদর্শন, আকাশবাণীর স্টেশন ডিরেক্টরের পদ ফাঁকা দীর্ঘদিন ধরেই। এই তালিকায় যুক্ত হল এনআইটি-ও। এনভি দেশপাণ্ডের মেয়াদ ফুরনোর পর অস্থায়ী ডিরেক্টরেই চলছে উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি। তবে ব্যতিক্রম আসাম বিশ্ববিদ্যালয়। এই বছরে দিলীপচন্দ্র নাথকে স্থায়ী উপাচার্য পদে নিয়োগ করা হয়। এনআইটি চত্বরে আব্দুল কালামের মূর্তি প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইনে ছাত্রভর্তি ইত্যাদি বিদায়ী বছরে বরাকের উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

প্রাপ্তির কোঠায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস, সম্পর্কক্রান্তিও। মে মাসে শিলচর জুড়ে যায় আগরতলার সঙ্গেও। কিন্তু ধসের আতঙ্ক কমেনি। ব্রডগেজে রেললাইন বন্ধ থেকেছে দু’মাসেরও বেশি সময়।

খেলাধূলায় সুখবর দিয়েই শুরু হয়েছিল ২০১৬। জানুয়ারিতে শিলচরে অনুষ্ঠিত হয় তৃতীয় রাজ্য ক্রীড়া উৎসব। সেখানে কাছাড় জেলার পদকের ছড়াছড়ি। রাজ্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে আয়োজক জেলা। এনএম গুপ্ত ট্রফিও শিলচরে বেশ সাড়া জাগিয়েছিল।

অনুবাদ উৎসব দিয়ে শুরু হয়েছিল ২০১৬। বছরভর চলে সুরমা সাহিত্য সম্মিলনী ও শ্রীভূমি পত্রিকা প্রকাশের শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠান। ঐতিহ্যের কত কথা যে উঠে এসেছে এ-উপলক্ষে! ব্রাত্যজনের নাট্যোৎসবও বছরের বড় প্রাপ্তি।

অম্রুতে শিলচরের ঠাঁই, ইভিএমের অবস্থান জানতে শিলচরের মোবাইল অ্যাপ, স্পাইসজেট বিমানের যাত্রা শুরু, স্টেট ব্যাঙ্কের শিলচর জোন চালুর ঘটনাও ২০১৬-র পক্ষে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় রাঙ্গিরখালে উচ্ছেদ অভিযানের কথা। একে ঘিরে সাধারণ মানুষ আশায় রয়েছেন, আগামী বর্ষায় শহরের জলজমার সমস্যা অনেকটাই কেটে যাবে।

তবে কাটিগড়ায় শতাধিক পরিবারকে কাঁটাতারের বেড়াজাল থেকে বের করে আনতে জমি বরাদ্দ হয়েছিল বিদায়ী বছরে। জমি-বিবাদে সেই পরিকল্পনা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। মূল ভূখণ্ডে বসবাসের স্বপ্ন বছরের শেষেও তাই তাঁদের কাছে অধরাই রইল।

পর পর বেশকিছু ভূমিকম্পের দরুন গোটা বছর আতঙ্কে কেটেছে। ৪ জানুয়ারির কম্পনের উৎস ছিল মণিপুর। বরাকের মানুষ সেদিন বড় ধরনের বিপদ থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। ৬ মার্চের জোড়া ভূমিকম্পও কম আতঙ্কের সৃষ্টি করেনি। ২১ এপ্রিল, ১৫ মে-র কম্পনও দুশ্চিন্তায় রাখে সবাইকে। এর ওপর, ভুবন পাহাড়ে মেঘভাঙা বৃষ্টি, মধুরায় হড়পা বানে ৮ শ্রমিকের প্রাণহানি প্রকৃতির রোষেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

উল্লেখ করতে হয় মেঘালয়ের সড়কে এই অঞ্চলের বাস দুর্ঘটনার কথা। হাইলাকান্দির বাস দুর্ঘটনায় পড়লে ১০ জনের মৃত্যু হয়। সোনাপুরে বাস খাদে গড়ালে ২৫ জন প্রাণ হারান।

আরও কিছু মৃত্যু এই বছর এই অঞ্চলের অপূরণীয় ক্ষতি ডেকে এনেছে। গত ২৩ জানুয়ারি রাতে ভাষাসংগ্রামের প্রধান সেনাপতি পরিতোষ পালচৌধুরীর মৃত্যু হয়। চিকিৎসক-সমাজসেবী রাহুল গুপ্তের প্রয়াণও বরাকের পক্ষে কম ক্ষতি নয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন