4 States Assembly Election Result

হিন্দি ভারতে বিপর্যস্ত কংগ্রেসকে ‘সান্ত্বনা’ দিল তেলঙ্গানা, কোন কোন অস্ত্রে কেসিআর ‘বধ’

সনিয়া গান্ধী, রাহুল গান্ধী এবং মল্লিকার্জুন খড়্গেদের আবেদনে সাড়া দিয়ে কংগ্রেসকে জেতাল ‘কিশোর’ তেলঙ্গানার জনতা। কোন অঙ্কে চলে তেলঙ্গানায় জয় হাসিল করল কংগ্রেস?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ২১:৩৫
Share:

রাহুল গান্ধী এবং কে চন্দ্রশেখর রাও। —ফাইল চিত্র ।

রাজস্থান এবং ছত্তীসগঢ় বিজেপি জোয়ারে ভেসে গেল। ধরাশায়ী কংগ্রেসের ‘খড়কুটো’ হল তেলঙ্গানা। তেলঙ্গানার কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের সরকারকে ফেলে দিয়ে জিতল কংগ্রেস। ২০১৪ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আলাদা হয়ে নতুন রাজ্য হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছিল তেলঙ্গানা। সে রাজ্যের প্রথম বিধানসভা ভোটে তাঁর দল জেতার পর মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন চন্দ্রশেখর (সারা দেশ অবশ্য তাঁকে কেসিআর নামেই বেশি চেনে)। ২০১৮ সালের তেলঙ্গানা ভোটেও মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ফিরেছিলেন। তবে ‘গড়’ রক্ষা করতে পারলেন না ২০২৩-এ। রাহুল গান্ধী, সনিয়া গান্ধী এবং মল্লিকার্জুন খড়্গের আবেদনে সাড়া দিয়ে কংগ্রেসকে জেতাল ‘কিশোর’ তেলঙ্গানার বাসিন্দারা। কিন্তু কোন সমীকরণ মেনে তেলঙ্গানায় জয় হাসিল করল কংগ্রেস?

Advertisement

১১৯ আসনের তেলঙ্গানা বিধানসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠতার জাদুসংখ্যা ৬০। কংগ্রেস ৬৫টি আসনে জিতে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়েছে। কেসিআরের বিআরএস (ভারত রাষ্ট্র সমিতি। আগে নাম ছিল টিআরএস বা তেলঙ্গনা রাষ্ট্র সমিতি) পেয়েছে ৩৯টি। তেলঙ্গানায় গত বিধানসভা নির্বাচনের পর তেড়েফুঁড়ে উঠলেও বিজেপি জিতেছে আরও ৮টি আসন। আসাদউদ্দিন ওয়েইসির দল ‘অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন’ (মিম) যে ৯টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল তার মধ্যে ৭টিতে জিতেছে।

মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়, তেলঙ্গানা এবং মিজ়োরাম থেকে বিধানসভা

বিআরএস-এর সঙ্গে এ বার মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল কংগ্রেসের। যেমনটা ছিল ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের বিধানসভা ভোটেও। তবে ২০১৮ সালের পর অনেক কিছু বদলেছে। ভোটপণ্ডিতদের মতে, কংগ্রেস যে সব ‘অস্ত্রে’ শান দিয়ে তেলঙ্গানার ভোট বৈতরণী পার করল, তার মধ্যে অন্যতম রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’। যাত্রা চলাকালীন তেলঙ্গানা থেকে ভাল সাড়া পেয়েছিল কংগ্রেস। সে রাজ্য থেকে বহু মানুষ যোগও দিয়েছিলেন। সেই ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’য় তেলঙ্গানায় কংগ্রেসের ভাঙা ঘর জোড়া লাগিয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।

Advertisement

পাশাপাশি তেলঙ্গানা জেতার ক্ষেত্রে কংগ্রেসের অঘোষিত মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি রেবন্ত রেড্ডির ‘ক্যারিশমা’ও কাজে এসেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি তথা মালকাজগিরির সাংসদ রেবন্ত এ বার নিজের পুরনো বিধানসভা কেন্দ্র কোডনগলের পাশাপাশি, কামারেড্ডি থেকেও প্রার্থী হয়েছিলেন। কোডনগলে জিতলেও হেরেছেন কামারেড্ডির বিজেপি প্রার্থীর কাছে। রেবন্তের কট্টর সমালোচকরাও স্বীকার করেন যে, তিনি এক জন প্রভাবী এবং শক্তিশালী বক্তা। রাজ্যের যুবসমাজেও তিনি জনপ্রিয়। কংগ্রেসের হেডকোয়ার্টার থেকে তেলঙ্গানার দলীয় নেতাদের মতবিরোধ এবং পারস্পরিক দূরত্ব সরিয়ে ফেলার দায়িত্বও রেবন্তকে দেওয়া হয়েছিল। রেবন্তের হাতে তেলঙ্গানা কংগ্রেসের লাগাম তুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কংগ্রেসের তুরুপের তাস হয়েছে বলেই মত সংশ্লিষ্ট মহলের।

অন্য দিকে, কয়েক মাস আগেই দক্ষিণ ভারতের কর্নাটক রাজ্যে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা পেয়ে জয়ী হয়েছে কংগ্রেস। বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যূত করে সরকার গঠন করেছে মুখ্যমন্ত্রীর সিদ্ধারামাইয়া। সেই বদলের হাওয়া তেলঙ্গানাতেও লেগেছিল বলে মনে করছেন ভোটপণ্ডিতেরা।

এ বছরের বিধানসভা নির্বাচনে কেসিআরের ‘হাতিয়ার’ ছিল গত ১০ বছরের নানা জনমুখী কর্মসূচি। আর তার প্রথমেই ছিল কৃষকদের জন্য ‘রায়তু বন্ধু যোজনা’। ওই প্রকল্পে প্রত্যেক কৃষককে প্রতি একর শস্য পিছু বছরে ১০ হাজার টাকার অনুদান দেওয়া হয়। তা দেওয়ার কথা বছরের গোড়ায়, অর্থাৎ জানুয়ারিতে। কিন্তু ২০১৮ সালে এই নভেম্বর মাসেই বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে কৃষিজীবী ভোটারদের অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকিয়ে দিয়েছিল কেসিআর সরকার। তবে কংগ্রেসের অভিযোগের ভিত্তিতে এ বার তা বন্ধ করে দেয় নির্বাচন কমিশন। বিআরএস সেই বিষয়টিকে ‘অস্ত্র’ করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোটের প্রচারে ব্যবহার করেছিল। সরাসরি ‘কৃষকবিরোধী’ বলে চিহ্নিত করেছিল রাহুল, মল্লিকার্জুন খড়্গেদের। এ বারের বিধানসভা ভোটে ‘দলিতবন্ধু যোজনা’ও শাসকদলের বড় ‘অস্ত্র’। প্রতিটি দলিত পরিবারকে বাড়ি তৈরির জন্য এককালীন ১০ লক্ষ টাকা করে দেওয়ার এই প্রকল্প ভোটের বাজারে সুফল দেবে বলে মনে করেছিল বিআরএস নেতৃত্ব। তবে কংগ্রেসের অভিযোগ ছিল, ভোটের শেষপর্বে ‘টাকা ছড়ানোর’ উপরে ভিত্তি করেই নির্বাচনে জিততে চাইছে চন্দ্রশেখরের দল।

তেলঙ্গানাতে এ বার বিআরএসের পাল্টা একগুচ্ছ প্রতিশ্রুতি সামনে রেখে লড়াইয়ে নেমেছিল কংগ্রেসও। ক্ষমতায় এলে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের ধাঁচে তেলঙ্গানার প্রতি পরিবারের গৃহকর্ত্রীকে মাসিক আড়াই হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি তো ছিলই, পাশাপাশি ছিল আরও অন্যান্য প্রতিশ্রুতি। অন্যান্য প্রতিশ্রুতির মধ্যে ছিল সরকারি বাসে মহিলাদের বিনা পয়সায় সফর, ৫০০ টাকায় গ্যাস সিলিন্ডার, নিখরচায় পরিবার পিছু ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ, গৃহহীনদের বিনামূল্যে জমি এবং পাঁচ লক্ষ টাকা অনুদান, ‘রাজীব আরোগ্যশ্রী’ প্রকল্পে ১০ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমা, কৃষকদের ১৫ হাজার টাকা বার্ষিক অর্থসাহায্য, পড়ুয়াদের পাঁচ লক্ষ টাকার ‘বিদ্যা ভরসা কার্ড’ দেওয়ার অঙ্গীকার। অসুস্থ অবস্থাতেও সে রাজ্যে প্রচারে গিয়ে এই সব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সনিয়া।

দলের নাম টিআরএস (তেলঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি) থেকে বিআরস (ভারত রাষ্ট্র সমিতি) করেছিলেন কেসিআর। রাজনৈতিক পণ্ডিতদের একাংশ এ-ও মনে করছেন, তেলঙ্গানাতে বিআরএস ধরাশায়ী হওয়ার অন্যতম কারণ, সেই নাম বদলের সিদ্ধান্ত। মনে করা হচ্ছিল, কেন্দ্রে প্রতিপত্তি তৈরি করতেই দলের নামে ‘ভারত’ জুড়েছিলেন কেসিআর। তবে যে ‘তেলঙ্গানা’ নামের সঙ্গে রাজ্যবাসীর আবেগ এবং বহু মানুষের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম জড়িয়ে, সেই নাম বদলে ফেলা কেসিআরের জেতার পরিপন্থী হয়েছে বলে মনে করছেন ভোটপণ্ডিতদের একাংশ।

ভোটগণনার ফল অন্য কথা বললেও নিজেদের দলের জয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী ছিলেন কেসিআর পুত্র কেটিআর। এক্স-হ্যান্ডলে তৃতীয় বার ক্ষমতায় ফেরার ইঙ্গিতও তিনি দিয়েছিলেন গণনার প্রায় এক দিন আগে। কিন্তু কেটিআর-এর স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে। ভোটগণনার ফল পরিষ্কার হতে তিনি আবার এক্সে লেখেন, ‘‘টানা দু’বার ক্ষমতায় রাখার জন্য তেলঙ্গানার জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ। ফলাফলে দুঃখিত নই, তবে অবশ্যই হতাশ। কারণ, এটি অপ্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু আমরা এটাকে আমাদের শিক্ষা হিসেবে নেব এবং ফিরে আসব। কংগ্রেস দলকে অভিনন্দন এবং শুভ কামনা।’’

২০১৮ সালে তেলঙ্গানা বিধানসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল কংগ্রেস। তৃতীয় স্থানে ছিল বিজেপি। তবে খেলা ঘোরে লোকসভায়। সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেসকে পিছনে ফেলে দিয়েছিল বিজেপি। খেলা আবার ঘুরেছে। তেলঙ্গানায় বিআরএস এবং বিজেপিকে টপকে সরকার গঠনের পথে কংগ্রেস। তবে, তেলঙ্গানায় জিতলেও কংগ্রেস রাজস্থান এবং ছত্তীসগঢ়ে কুর্সি হারিয়েছে। মধ্যপ্রদেশেও গেরুয়া ঝড়ে বিপর্যস্ত রাহুলের দল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন