যোগের পরে বেদের পালা!
ঋগ্বেদ কবে লেখা হয়েছিল? খ্রিস্টের জন্মের দেড়-দু’হাজার বছর আগে? নাকি আরও পিছিয়ে? ভারতীয় সভ্যতার প্রথম পূর্বপুরুষ কি হরপ্পা-মহেঞ্জোদড়োর সিন্ধুসভ্যতা? নাকি ঋগ্বেদ তার চেয়েও প্রাচীন? আর্যরা কি বহিরাগত? নাকি ভারতেরই সন্তান?
প্রায় দু’শো বছর ধরে চর্চিত এই প্রশ্নগুলি ফের মাথা চাড়া দেবে আগামী সেপ্টেম্বরে। স্মৃতি ইরানির নেতৃত্বাধীন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের উদ্যোগে তখন বেদের সময়কাল নিয়ে তিন দিনের সম্মেলন বসবে দিল্লিতে। সম্মেলনের মূল সুরই হবে ঋগ্বেদ কবে লেখা হয়েছিল তার প্রকৃত সময়টি খোঁজা। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ছাড়াও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগ, উজ্জয়িনীর মহর্ষি সন্দীপনী রাষ্ট্রীয় বেদবিদ্যা প্রতিষ্ঠান থেকে আর্যসমাজের প্রতিনিধিরা যোগ দেবেন এই সম্মেলনে। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসের অধ্যাপক রণবীর চক্রবর্তী হাসছেন, ‘‘খবরটা ঠিক হলে বলতে হবে বিস্ময়কর মূঢ়তা। বৈদিক সংহিতা মানেই অপৌরুষেয়। ঋগ্বেদকে যাঁরা লিখিত সংস্কৃতির মধ্যে আনতে চান, ঋগ্বেদ কবে লেখা হল সেটাই প্রধান সমস্যা বলে ভাবেন, তাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতির কিছু জানেন না।’’
বিশিষ্টদের মতে, বৈদিক সাহিত্য কখনও লিখিত রূপের ওপর জোর দেয়নি। বেদ মানেই শ্রুতি। তার লিখিত রূপ অনেক পরের সময়ের কথা। ফলে কাশ্মীরে এক রকম, বাংলায় আর এক, তামিলনাড়ুতে অন্য রকম রামায়ণ-মহাভারত পাওয়া গেলেও বেদ নিয়ে সেই সমস্যা হয়নি। তার লিখিত রূপভেদ নেই, তাই দরকার হয়নি কোনও ‘ক্রিটিকাল এডিশন’। এই কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে বসে উনিশ শতকে উইলসন তাই অনুবাদ করেন ঋগ্বেদ। কোনও পাঠান্তর বা পাঠভেদের বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না তাঁকে। আজও পুণের ভান্ডারকর রিসার্চ ইনস্টিটিউটে ঋগ্বেদের সবচেয়ে প্রাচীন পাণ্ডুলিপিটি গাছের ছালের উপর ১৪৬৪ সালে লেখা। এটি ইউনেস্কোর ‘মেমরি অব ওয়র্ল্ড রেজিস্টার’-এর অন্তর্ভুক্ত।
মন্ত্রকের খবর, সেপ্টেম্বরের সম্মেলনের আসল হোতা সঙ্ঘ পরিবার। খ্রিস্টপূর্ব আট থেকে দশ হাজার বছর আগেই যে ঋগ্বেদ লেখা হয়েছিল, সেই তত্ত্বকেই প্রতিষ্ঠা দিতে চায় তারা। সে ক্ষেত্রে সিন্ধুসভ্যতাও বৈদিক সভ্যতার তকমা পাবে ও সঙ্ঘ পরিবারের তত্ত্ব অনুযায়ী আর্যদের আর বহিরাগত বলে মানতে হবে না। এই তত্ত্বই ইতিহাসের পাঠ্যসূচিতেও ঢোকাতে চায় তারা। বাজপেয়ী সরকারের সময়েও এ নিয়ে জলঘোলা হয়েছিল। মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রকের সংসদীয় কমিটির সদস্য সিপিএম সাংসদ ঋতব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেই ফেললেন, ‘‘বিজেপি ক্ষমতায় এলেই নতুন ইতিহাস রচনা করতে চায়।’’
যদিও ঋগ্বেদ যে ঊষার বর্ণনা দেয়, সোমলতার কথা বলে, তার নদী-প্রকৃতি সবই যে আফগানিস্তান-পাকিস্তান অঞ্চলের, তা পণ্ডিতেরা বহু বার বলেছেন। আফগানিস্তানের বোখাজকই শিলালিপির সঙ্গে ঋগ্বেদের ইন্দো-ইরানীয় ভাষার মিলের কথাও বলা হয়েছে বারংবার। নীরদচন্দ্র চৌধুরীর ‘হিন্দুইজ্ম’ বইতেই এ নিয়ে হরেক কথা আছে। কিন্তু বাজপেয়ীর আমলে নতুন ইতিহাস রচনার প্রয়াস সে বার থামিয়ে দেন সেই প্রবাসী বাঙালি বৃদ্ধই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আডবাণী তখন অক্সফোর্ডে নীরদবাবুর বাড়িতে দেখা করতে গিয়েছেন। ‘আত্মঘাতী বাঙালি’র দুর্মুখ রচনাকার তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘‘আপনি ঋগ্বেদ পড়েছেন?’’ উত্তর: ‘না’। হতাশ নীরদবাবু: ‘‘তা হলে আর হিন্দুধর্ম নিয়ে আপনার সঙ্গে কী কথা বলব?’’
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের প্রধান রমেশ ভরদ্বাজের মতে, ‘‘বাল গঙ্গাধর তিলক, জার্মান পণ্ডিত ফেলিক্স জ্যাকোবি মনে করতেন, ঋগ্বেদ খ্রিস্টের জন্মের আট হাজার বছর আগে লেখা হয়েছিল।’’ কিন্তু ঋগ্বেদকে যিনি বিশ্বের দরবারে প্রথম পরিচিত করেন, সেই ম্যাক্সমুলারও তিলকের মতো এত দূর পিছিয়ে যাননি। তিনি খ্রিস্টের জন্মের দেড় হাজার বছর আগের কথা ভেবেছিলেন। আর আর্যভাষাটি যে শুধুই ভারতীয় ভাষা নয়, সে কথাও ইতিহাসের দরবারে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত। শেল্ডন পোলক পরিষ্কার লিখে দিয়েছেন, সংস্কৃত নামক কসমোপলিটান ভাষাটি আফগানিস্তান থেকে জাভা সর্বত্র চলত। রোমিলা থাপারও ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর সঙ্গে ঋগ্বেদের ‘মিত্রাবরুণ’ গোছের দেবতার অনেক মিল পেয়েছেন।
তা হলে পুরনো বাতিল মদ ফের নতুন সেমিনারের বোতলে কেন? আর্য যে এক ভাষাগোষ্ঠীর নাম, তা সারস্বত চর্চায় প্রতিষ্ঠিত সত্য। ঋগ্বেদের বয়স পিছিয়ে গেলেই বা কী লাভ হবে? রণবীরবাবুর দাবি, ‘‘কারা প্রকৃত আর্য, কারা জাতিশ্রেষ্ঠ সে সব নিয়ে উনিশ শতকে চিন্তা হতো। পৃথিবী তার বিষময় ফল ভুগেওছে। সেই চিন্তা যদি একুশ শতকে ফিরে আসে, সেটি শুধু হাস্যকর নয়, বিপজ্জনকও।’’
বেদ সম্মেলন এখন কোন সিদ্ধান্তে আসে, সেটাই দেখার।