উত্তরপ্রদেশের ভোটের মুখে নাটকীয়ভাবে কৌশল বদলে আরএসএসের সঙ্গে প্রকাশ্য সমরে গেলেন রাহুল গাঁধী।
লোকসভা নির্বাচনের প্রচারের সময় মহারাষ্ট্রের এক সভায় রাহুল বলেছিলেন, আরএসএসের লোকেরা মহাত্মা গাঁধীকে হত্যা করেছিলেন। এর পর আরএসএস আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করে। সেই অভিযোগ খারিজের দাবি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন রাহুল। মানহানির মামলা থেকে বাঁচতে সুপ্রিম কোর্টে এর আগে রাহুল বলেছিলেন, তিনি গাঁধী-হত্যার জন্য গোটা আরএসএসকে দায়ী করেননি।
কিন্তু সেই মন্তব্যের পর রাজনৈতিক খেসারত দিতে হয় বলেই ফের ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। আজ, বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্টে তিনি বলেন, আরএসএসের ‘লোকেরা’ গাঁধী-হ্ত্যা করেছেন বলে যে মন্তব্য তিনি করেছেন, তাতে তিনি অনড়। সুপ্রিম কোর্টে মামলা প্রত্যাহার করে মহারাষ্ট্রের ভিওয়ান্ডি আদালতে শুনানির মুখোমুখি হতেও তিনি রাজি। রাহুলের কৌশুলী কপিল সিব্বল কংগ্রেসের সহ-সভাপতির সশরীরে হাজির না থাকার অনুরোধ করেন। কিন্তু শীর্ষ আদালত তা খারিজ করে দেয়। ফলে নভেম্বরে পরের শুনানিতে রাহুলকে সশরীরে হাজির থেকেই শুনানির মুখোমুখি হতে হবে।
প্রশ্ন হল, মানহানির মামলা থেকে নিষ্কৃতি চাওয়ার পরেও এখন রাহুল কেন নিজের কৌশল বদলে আরএসএসের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যেতে গেলেন?
কংগ্রেসের শীর্ষ সূত্রের খবর, প্রতিষ্ঠান হিসেবে আরএসএস যে গাঁধীকে হত্যা করেনি, আদালতে এ কথা বলে পার পেয়ে যাওয়ার পরামর্শ রাহুলকে দেওয়া হয়েছিল। তা করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হয়। গোটা গেরুয়া শিবির প্রচার করতে থাকে, রাহুল পিছু হঠেছে। আরএসএসও এই সুযোগে রাহুলকে আরও চাপে রেখে তাঁর থেকে ক্ষমা আদায় করে নিতে চাইছিল। উত্তরপ্রদেশের ভোটের মুখে রাহুলের এই পিছু হঠায় মুখ পুড়ছিল গোটা কংগ্রেসেরই। এই পরিস্থিতিতে রাহুল নিজেই ঘনিষ্ঠ কয়েকজনের সঙ্গে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেন, ক্ষমা না চেয়ে তিনি নিজের বক্তব্যে অনড় থাকবেন। ইতিহাসের পাতায়, বিভিন্ন বই এমনকী সরকারি নথিতেও বারবার লেখা হয়েছে, গাঁধী-হত্যাকারী নাথুরাম গডসে সরাসরি আরএসএসের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার পটেলেরও একাধিক চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে, সঙ্ঘ সাম্প্রদায়িক কাজে লিপ্ত। গাঁধী-হত্যার পর আরএসএস মিষ্টিও বিতরণ করেছিল। ফলে এই ধরণের মন্তব্য তিনিই প্রথম করেননি। এঁদের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা না হলে কেন শুধু রাহুলের বিরুদ্ধে হবে?
আরও পড়ুন: গাঁধী হত্যা নিয়ে নয়া যুক্তি কংগ্রেসের
এই পরিস্থিতিতে শুনানি শেষে রাহুলের যদি সাজাও হয়, তাহলেও আরএসএসের মতো ‘বিভাজনকারী’ শক্তির সঙ্গে রাজনৈতিক ও আদর্শগত লড়াই করে শহিদের তকমা পেতে পারেন তিনি। এই সূত্র ধরে এক দিকে ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে নেহরু-গাঁধী পরিবারের ঐতিহ্যকেও পুনরুজ্জীবিত করা যাবে, মোদী জমানায় যা ক্ষয়িষ্ণু হতে চলেছে। আর উত্তরপ্রদেশের ভোটের আগে দলের কর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করে একদিকে সংখ্যালঘুদের ভোট টানা যাবে, তেমনই আধুনিক হিন্দুদেরও কাছে টানা সম্ভব। যে কারণে রাহুলের কৌঁশুলি কপিল সিব্বল বলেছেন, ‘‘আসল লড়াই হল, আরএসএসকে বলতে হবে নাথুরাম গডসে প্রকৃত হিন্দু ছিলেন কি না। আসল হিন্দু কখনও গাঁধীকে মারতে পারে না। আমিও হিন্দু, কিন্তু আরএসএসের বিচারধারা আমি মানি না।’’
আরএসএস নেতৃত্ব মনে করছেন, রাহুলের এই সাম্প্রতিক ভোল বদলের পিছনে রয়েছে গতকালের হরিয়ানায় ধিংরা কমিশনের রিপোর্ট। গাঁধী পরিবার ভয় পাচ্ছে, সনিয়া গাঁধীর জামাই রবার্ট বঢরার জমি কেলেঙ্কারি সামনে আসছে। তাই রাহুল মোড় ঘোরাতে একটি সাহসী মুখ দেখাতে চাইছেন। এ বারে প্রথম শুনানিতেই তাঁকে জামিন নিতে হবে। সঙ্ঘের নেতা মনমোহন বৈদ্য বলেন, ‘‘তাহলে রাহুল গাঁধী কোনও না কোনও অজুহাতে গত দু’বছর ধরে কেন শুনানি এড়ালেন? তিনি কি সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছিলেন?’’ রাহুলের এই মত বদলের মুখে গোটা বিজেপি শিবির আজ সামনে এসে বলার চেষ্টা করে, রাহুল ইতিহাস জানে না। সঙ্ঘের উপর এক সময় যেমন প্রতিবন্ধকতা আরোপ হয়েছিল, সেই নেহরুই আবার সেটি তুলে নিয়ে প্যারেডে আপ্যায়ণ করেছিলেন।
আরএসএসের কৌঁশুলি আজ আদালতে রাহুলের আইনজীবীকে দিয়ে বলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, গাঁধী-হত্যার জন্য আরএসএস কোনওভাবেই দায়ী নয়। সিব্বল বলেন, নতুন কোনও মন্তব্য করা হবে না। তবে রাহুল যা বলেছেন, তাতে কায়েম রয়েছেন। বিজেপি নেতা শ্রীকান্ত শর্মা বলেন, ‘‘এই রাহুলের বাবা রাজীব গাঁধী এক সময় বলেছিলেন, বড় গাছ পড়লে জমি নড়ে যায়। তা হলে তো শিখ দাঙ্গার জন্য গোটা কংগ্রেসকে জেল যেতে হয়। জরুরি অবস্থার সময় নির্দোষদের জেলে পাঠানোর জন্য কংগ্রেসকে জেলে যেতে হয়। আরএসএস সমাজসেবী সংগঠন। ইতিহাস তার সাক্ষী। উত্তরপ্রদেশ নির্বাচনের আগে রাহুল শুধুমাত্র সংখ্যালঘু তোষণ করতে চাইছেন।’’