সাহিত্যিকরা এগিয়ে এলে দর্শক পাবে বরাকের নাটক

বরাক উপত্যকার নাটকের মান যথেষ্ট উন্নত, এ শুধু উপত্যকাবাসীরই দাবি নয়। এখান থেকে নাটক নিয়ে যে দল যেখানেই গিয়েছে, শুনে এসেছে সে কথা। আবার যাঁরা বাইরে থেকে এখানে এসে নাটক করে গিয়েছেন, তাঁরাও নানা ভাবে একই কথা বলে গিয়েছেন।

Advertisement

সুব্রত রায়

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০১৬ ০৩:৩২
Share:

বরাক উপত্যকার নাটকের মান যথেষ্ট উন্নত, এ শুধু উপত্যকাবাসীরই দাবি নয়। এখান থেকে নাটক নিয়ে যে দল যেখানেই গিয়েছে, শুনে এসেছে সে কথা। আবার যাঁরা বাইরে থেকে এখানে এসে নাটক করে গিয়েছেন, তাঁরাও নানা ভাবে একই কথা বলে গিয়েছেন। কিন্তু তাতে আহ্লাদিত হওয়ার মতো কিছু দেখতে পাই না। কারণ এখানকার নাটকের মান নিয়ে যে মন্তব্যই শুনি না কেন, শেষ কথা হল, বরাকে নাটকের দর্শক মেলে না। নবীন সংগঠনগুলির কথা বাদই দেওয়া গেল। প্রতিষ্ঠিত কয়েকটি নাট্যসংস্থার কথা বললেও তা সমান প্রযোজ্য। সকলের ওই এক আক্ষেপ— বহু খাটাখাটনি করে একটি নতুন নাটক মঞ্চের উপযোগী করে তুলতে হয়। কিন্তু দেখা যায়, এক বা দু’টি উপস্থাপনাতে ভালই দর্শক পাওয়া যায়। তৃতীয় বার দেখাতে গেলেই হল প্রায় ফাঁকা।

Advertisement

ভাবীকালের ‘ম্যাকবেথ’, ‘মনসা’, দশরূপকের ‘আইজও আন্ধার’, ‘সুখপাখি’, গণসুরের ‘দায়বদ্ধ’, কালচারাল ইউনিটের ‘জিম্মা’, ‘যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্ত’— সব নাটকেই ওই এক অভিজ্ঞতা। দু’তিনটি প্রযোজনা ভাল লোক টেনেছে। তার পরই দর্শক সীমিত হয়ে পড়ছে।

বিস্ময়ের কথা হল, নাটক রচনা সাহিত্যসৃষ্টিরই অঙ্গ। কিন্তু বরাক উপত্যকায় সাহিত্য জগতের লোকজন নাটক লেখা ও দেখা থেকে দূরে থাকেন। অথচ তাঁরা এই কাজটি করলে আমরা ঋদ্ধ হতাম।

Advertisement

কেন এই পরিস্থিতি, এ থেকে উত্তরণের কী উপায়, এমন বহু প্রশ্ন নাট্যকার ও অভিনেতাদের মনে ঘুরে বেড়ায়। ৬ জুলাই সন্ধেয় সে সব বিষয় একে একে উঠে আসে। সে দিন অন্তরঙ্গ আলাপচারিতা ছিল দুই নাট্যকার চিত্রভানু ভৌমিক ও শেখর দেবরায়ের সঙ্গে। ও-পারে একঝাঁক নাট্যকর্মী।

আসলে সে দিন অমলেন্দু ভট্টাচার্য সম্পাদিত নাট্য সংকলন ‘ত্রিধারা’ আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রকাশিত হয়। তাতে রয়েছে চিত্রভানু ভৌমিকের নাটক ‘সুখপাখি এবং শেখর দেবরায়ের দু’টি নাটক ‘মনসা কথা’ ও ‘যুধিষ্ঠিরের সিদ্ধান্ত’। মোড়ক খুলে সংকলনটির উন্মোচন করেন এই অঞ্চলের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মনুজেন্দ্র শ্যাম। নাটক তিনটি নিয়ে আলোচনা করেন তুষারকান্তি নাথ, ঝুমুর পান্ডে ও দেবশ্রী দত্ত।

অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্ব ছিল আমার হাতে। মূল পর্বের নানা কথায় আমার মনে হল, শুধু নাট্যকারদের বক্তৃতা শুনে সব বিষয় পরিষ্কার হয় না। কারও বক্তৃতার মধ্যে কিছু জিজ্ঞাসা করাও দৃষ্টিকটু। তার ওপর তাতে নির্ধারিত অনুষ্ঠান দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। দর্শকরাও অস্বস্তি বোধ করেন। তাই উন্মোচন অনুষ্ঠান, আলোচনার পর সভার সভাপতি তৈমুর রাজা চৌধুরী যখন সমাপ্তি ঘোষণা করেন, তখন দুই নাট্যকারের মুখোমুখি বসি আমরা। নাট্যপ্রেমীর সংখ্যাটা কিন্তু মন্দ ছিল না। ছিলেন নাট্য সংকলন ‘ত্রিধারা‘র সম্পাদক অমলেন্দু ভট্টাচার্যও।

একে একে উঠে আসে এই অঞ্চলের নাটকের নানা সমস্যার কথা। বিশেষ করে এখানে বহু নাটক লেখা হয়েছে। কিন্তু বেশির ভাগই লেখা হয়, নিজের সংস্থার ব্যানারে মঞ্চস্থ করার কথা ভেবে। লেখা শেষ হতেই নাট্যকার সহসাথীদের ডেকে মহড়া শুরু করেন। ফলে এক সংস্থার কর্মকর্তার লেখা নাটক আরেক সংস্থার অভিনয় করার সুযোগ মেলে না। এখানকার নাট্য সংস্থাগুলির মধ্যে বিরোধের কোনও জায়গা নেই বটে, তবে এর নাটক ওর করার মধ্যে দিয়ে বাঁধন যতটা শক্ত হতো, তা কিন্তু হচ্ছে না।

অমলেন্দু ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘সৃষ্টির আনন্দে স্থানীয় নাট্যকাররা নাটক লিখছেন বটে, কিন্তু ছাপানোর দায়িত্ব কে নেবেন, এটাই সমস্যা। কারণ এর সঙ্গে অর্থ ও বিপণনের একটা ব্যাপার রয়েছে। ছাপা নাটক থাকলে এই সমস্যা হতো না।’’ এই অঞ্চলের নাটক অভিনয়-প্রতিভা ও সাহিত্য-গুণে প্রশংসনীয় বলেই মন্তব্য করেন তিনি। সে কথার সূত্র ধরে চিত্রভানু ভৌমিক জানান, শীঘ্রই তাঁর লেখা নাটকের একটি সংকলন বেরচ্ছে। তখন অন্যরাও ওই সব নাটক মঞ্চস্থ করতে পারবেন।

দেবারতি চন্দ নাটক নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনিও বলেন, ‘‘এখানকার নাট্য সংকলন কোথায়?’’ প্রয়াত বিশ্বজিৎ চৌধুরীর নাটকগুলিকে সংকলিত করার জন্য উদ্যোগী হতে তিনি আবেদন জানান। উল্লেখ করেন তাঁর ‘শহিদ দিবস‘, ‘লজ্জা‘, ‘চড়ক‘ প্রভৃতি নাটকের কথা। জানা যায়, নাট্যাঙ্গন সে চেষ্টা শুরু করেছে। অন্যরা সে কাজে সব ধরনের সাহায্য করার অঙ্গীকার করেন।

চিত্রভানু ভৌমিক বললেন, ‘‘সুন্দর গল্প তুলে ধরা চাই। শুধু গবেষণা চলতে থাকলে বোদ্ধাদের বাইরে নাটক দেখতে অন্য কেউ আর আসবেন না।’’ আবার এখান থেকে একটুকরো, ওখান থেকে একটুকরো নিয়ে জগাখিচুড়িতেও আপত্তি ভৌমিকবাবুর।

কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে আমার যে আক্ষেপ, সে দিনের আলোচনায় দেখলাম অনেকেরই ওই একই অভিমত। নাট্যকার কি অভিনেতা সবাই জানতে চান, নাটকের ব্যাপারে লেখক-সাহিত্যিকরা নির্লিপ্ত কেন? অনেকে মনে করেন, তাঁরা বেশি করে এলে স্থানীয় নাট্যজগত অধিকতর সমৃদ্ধ হতো।

অমলেন্দু ভট্টাচার্যের মতো শিক্ষাবিদ, লোকগবেষক নাটকের কাজে এগিয়ে আসায় আমরা যথেষ্ট লাভবান হয়েছি। তিনি আগ্রহ না দেখালে ‘ত্রিধারা‘ প্রকাশ হতো না। এমনকী, শেখর দেবরায়ের ‘মনসা কথা‘ লেখা হতো কিনা এ নিয়েও সংশয় জাগে।

আমি যেমন নিজের কথায় বলতে পারি, ৩০ বছর ধরে নাটক করছি। উপত্যকার সাহিত্য জগতের অনেকে রয়েছেন যাঁরা এক দিনও আমার নাটক দেখেননি। ‘আমি মদন বলছি’ ও ‘শেষ সংলাপ’ অন্তত ২০০ বার করেছি, এর পরও অনেক কবি-সাহিত্যিক রয়েছেন, যাঁরা এখনও পর্যন্ত নাটকগুলি দেখেননি। হয়তো আমরাই তাঁদের কাছে সে ভাবে পৌঁছতে পারিনি। অথচ তাঁরা দেখে বিশ্লেষণ করলে অনেক লাভবান হতাম আমরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন