গতির খোঁজে ভারতীয় ডাক সেজে উঠছে বিলিতি মডেলে

অন্ধকার ঘরে ঘাড় গুঁজে লিখছেন পোস্টমাস্টার। দূর থেকে অবাক হয়ে দেখছে রতন। রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের ওই ছবিতেই এখনও আটকে রয়েছে এ দেশের বেশির ভাগ গ্রামীণ ডাকঘর। শহরেও বিভিন্ন এলাকায় মালিন্যই তাদের নিত্যসঙ্গী। চুন-খসা নোংরা দেওয়াল। কোথাও লটকে আধছেঁড়া পোস্টার। উপরে তাকালে কালি-ঝুল, কত কাল যে ঝাড়পোছ হয়নি কে জানে! ছেঁড়া-ফাটা ফাইলের স্তূপ। কাউন্টারের সামনের জালে পরতে পরতে ধুলো। চারটে কাউন্টার থাকলে হয়তো গোটা দুয়েক খোলা।

Advertisement

সুনন্দ ঘোষ

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৪ ০৩:৫৬
Share:

অন্ধকার ঘরে ঘাড় গুঁজে লিখছেন পোস্টমাস্টার। দূর থেকে অবাক হয়ে দেখছে রতন।

Advertisement

রবীন্দ্রনাথের ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পের ওই ছবিতেই এখনও আটকে রয়েছে এ দেশের বেশির ভাগ গ্রামীণ ডাকঘর। শহরেও বিভিন্ন এলাকায় মালিন্যই তাদের নিত্যসঙ্গী। চুন-খসা নোংরা দেওয়াল। কোথাও লটকে আধছেঁড়া পোস্টার। উপরে তাকালে কালি-ঝুল, কত কাল যে ঝাড়পোছ হয়নি কে জানে! ছেঁড়া-ফাটা ফাইলের স্তূপ। কাউন্টারের সামনের জালে পরতে পরতে ধুলো। চারটে কাউন্টার থাকলে হয়তো গোটা দুয়েক খোলা।

গ্রাম-শহরে ডাকঘরের এই চেহারাটাই যেন গা-সওয়া হয়ে

Advertisement

গিয়েছে গ্রাহকদের। উপরি পাওনা, কর্মীদের একটা বড় অংশের অপেশাদারি মনোভাব।

ডাকঘরের এই ছবি বদলে ফেলতে এ বার তৎপর হয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। ঝকঝকে তকতকে, কর্পোরেট-দর্শনের সঙ্গে মানানসই পরিচ্ছন্ন কাউন্টার। সাজানো-গোছানো বসার জায়গা। কাউন্টারে ধোপদুরস্ত কর্মী। এমনটাই হবে আগামী দিনের ডাকঘর। কেন্দ্রীয় সরকারের সে রকমই পরিকল্পনা। ব্রিটিশ আমলে তৈরি এত বড় একটা ‘নেটওয়ার্ক’ হেলায় নষ্ট করতে চান না প্রধানমন্ত্রী। উন্নত দেশগুলিকে দেখে এই ব্যাপারে যে শিক্ষা নেওয়া প্রয়োজন, সে কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ। তাঁর কথায়, “ডাকঘরের এই বিশাল ব্যাপ্তিকে ব্যবহার করে ইউরোপ। সেখানে প্রত্যন্ত এলাকাতেও আধুনিক ডাক পরিষেবা মেলে এবং মানুষ তার সুবিধা নেন। এ দেশেও যাতে তা করা যায়, তার জন্যই এই পরিকল্পনা।” ইংল্যান্ডের ডাকঘরে এখন বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন হয়, ভ্রমণ-বাড়ি-গাড়ির বিমা করা যায়। সম্প্রতি সেখানকার জাতীয় ডাকব্যবস্থা ‘রয়্যাল মেল’ থেকে একটি শাখা বেরিয়ে মোবাইল পরিষেবা চালু করেছে।

ভারতে এখন দেড় লক্ষেরও বেশি ডাকঘর রয়েছে। যেগুলির সাহায্যে প্রত্যন্ত এলাকাতেও মানুষের কাছে পৌঁছনো সম্ভব বলে মনে করছে কেন্দ্র। ভবিষ্যতে সামাজিক প্রকল্প রূপায়ণে ডাকঘর বড় ভূমিকা নিতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। মোদি-সরকার এই ব্যাপারে ইংল্যান্ডের পথে হাঁটার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাই সরকারি নির্দেশ পৌঁছেছে সব ডাকঘরে। প্রথম ধাপে চেহারা বদল। সরাতে হবে পুরনো সাইন বোর্ড, ভাঙা কম্পিউটার, আসবাব, পোস্টার। অপেশাদারি মনোভাব থেকে বার করে আনতে হবে কর্মীদের। তার পরে ধাপে ধাপে আধুনিক ব্যবস্থা, আধুনিক পরিষেবার জন্য তৈরি হতে হবে।

বিদেশে উন্নত ডাকব্যবস্থার ছবিটা জানালেন ম্যাঞ্চেস্টারের বাসিন্দা অনাবাসী ভারতীয় শুভজিৎ দত্তরায়। তাঁর কথায়, “মানুষ রয়্যাল মেল-এর উপরে খুবই ভরসা করে। গ্রিটিংস কার্ড দেওয়া-নেওয়া তো রয়েছেই, তার সঙ্গে গ্যাসের বিল থেকে শুরু করে সাধারণ কাগজপত্র সবই পাঠানো হয় রয়্যাল মেল মারফত।” নিউ জার্সির বাসিন্দা রানা রায় জানান, সেখানে ডাকঘর মারফত প্রধানত চিঠিপত্র চালাচালিই হয়। তার বাইরে অন্য পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে এখনও সরকারের তেমন ভাবনা-চিন্তা নেই। আর, ডাকটিকিট এখন বাড়িতে বসেই ছাপিয়ে নেওয়া যায়।

পশ্চিমবঙ্গের চিফ পোস্টমাস্টার জেনারেল যশবন্ত পণ্ডা জানান, গ্রাহক সংখ্যা বাড়ছে। বয়স্কদের সংখ্যাই বেশি। বেশির ভাগ ডাকঘরে তাঁদের বসার জায়গা থাকে না। আবর্জনা সরিয়ে ফেললেই গ্রাহকদের বসার জায়গা করা যাবে। যশবন্ত বলেন, “ডাকঘরগুলির মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থাও করা হচ্ছে। পরিচ্ছন্নতা এবং পরিষেবার মাপকাঠিতে এ বার এক-একটি ডাকঘরকে পুরস্কার দেওয়া হবে।” রাজ্যে ডাকঘরের সংখ্যা ১০ হাজার। যশবন্ত পণ্ডা ইতিমধ্যেই ২০টি ডাকঘর ঘুরে দেখেছেন। অবস্থা দেখে তাঁর চক্ষু চড়কগাছ। এক পোস্টমাস্টার জানান, মানি অর্ডার, রেজিস্টার্ড চিঠির ক্ষেত্রে ডেলিভারি স্লিপ রেখে দেওয়ার কথা ১৮ মাস। স্পিড পোস্টের ক্ষেত্রে ছ’মাস। দেখা যাচ্ছে, ২৫ বছর আগের ডেলিভারি স্লিপও জমে রয়েছে। জমতে জমতে পাহাড় হয়ে গিয়েছে।

যশবন্ত বলেন, “নতুনদের ক্ষেত্রে পেশাদারি মনোভাবে ঘাটতি নেই। আমরা পুরনো কর্মীদের জন্য ক্লাস শুরু করেছি।” তিনি জানান, রাজ্যের ৪৮টি বড় ডাকঘরকে ইতিমধ্যেই জুড়ে দেওয়া হয়েছে ইন্টারনেট মারফত। বাকি ডাকঘরগুলিকেও জুড়ে নেওয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে।

কেবল ডাকঘরই নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের অন্য দফতরগুলিতেও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ গড়ে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। সরকারি সূত্রের খবর, সম্প্রতি বিভিন্ন দফতরের সচিবদের নিয়ে বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। তার পরেই কেন্দ্রীয় সরকারি সব অফিসকেই পরিচ্ছন্ন করে তোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বছরের পর বছর ফাইল জমিয়ে রাখা যাবে না। নোংরা, রাজনৈতিক পোস্টার মারা দেওয়াল সাফ করে ফেলতে হবে। ডাক বিভাগের মতোই নড়েচড়ে বসেছে রেল দফতর। স্টেশনে টিকিটের কাউন্টারগুলি পরিষ্কার করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে কর্মীদের।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন