একাকী ইন্দিরার কাছে শান্তিনিকেতন ছিল ছায়াঘন পরিসর

সেখানে কবির স্মৃতির কাছে এসে বসেন দেশনায়ক। লিখছেন বিশ্বজিৎ রায় সেখানে কবির স্মৃতির কাছে এসে বসেন দেশনায়ক। লিখছেন বিশ্বজিৎ রায়

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৯ নভেম্বর ২০১৭ ১৭:৪৮
Share:

শান্তিনিকেতনে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ভাষণরত ইন্দিরা গাঁধী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

১৯৬৭-র ২৪ ডিসেম্বর। বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে এসেছেন ইন্দিরা। বিশ্বভারতীর তিনি তখন আচার্য, ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাজনৈতিক জটিলতার অলিন্দে তাঁকে বিচরণ করতে হয়। ১৯৬৭ উত্তাল সময়, নকশালবাড়ির নির্ঘোষ শোনা যাচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা যাঁদের হাতে তাঁদের কাছে এ আন্দোলন অশান্তির, দেশদ্রোহিতার। শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা যেন নিজের রাজনৈতিক মতাদর্শের পক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছেন। না সাজালেও ক্ষতি ছিল না। এ তো রাজনীতির আসর নয়, সমাবর্তন মঞ্চ। তবু রাজনীতির কথা এসেই যাচ্ছে। সেদিনের সেই সমাবর্তন ভাষণ প্রিয়দর্শিনী শুরু করেছিলেন বাংলায়।

Advertisement

১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে গুরুদেবের শান্তিনিকেতনে ম্যাট্রিকুলেশনের গণ্ডী ডিঙিয়ে ছাত্রী হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ইন্দিরা। বেশি দিন পড়েননি কবির প্রতিষ্ঠানে, মাত্র বছরখানেক। তখনই বেশ বাংলা শিখেছিলেন, শিখেছিলেন হিন্দিও। পিতা জওহরলাল চেয়েছিলেন ‘ইন্দু-বয়’ ভারতীয় ভাষা শিক্ষায় মন দিক। কম বয়সেই ভাষা শেখা সহজ। একটু প্রতিকূলতার মধ্যে দিনযাপন করুক সে। ভোর সাড়ে চারটের সময় শান্তিনিকেতনে ঘুম ভাঙত ইন্দুর। শ্রী-সদনে ফ্যান ঘুরত না মাথার ওপর। গরম সয়ে গিয়েছিল একটু একটু করে। ইন্দু মায়ের কাছে আনন্দভবনে থাকলে ব্রাউন ব্রেড, মাখন, টাটকা ফল খেত সকালে। শান্তিনিকেতনে খেতে হত ডাল আর পুরী। ভোর৬টার সময় সেই পুরী আর ডাল যে অসহ্য তা জওহরলালও খানিকটা মেনে নিয়েছেন। তবে আগের একটা চিঠিতে মেয়েকে বেশ বকুনিই দিয়েছিলেন বাবা।

শান্তিনিকেতনে এসে ইন্দিরা থাকা-খাওয়ার আলাদা ব্যবস্থা করবে ভেবেছিল। জওহরলাল মেয়েকে চিঠিতে বুঝিয়েছেন এমন ব্যবস্থা করলে কোনও সহপাঠীই ইন্দিরার সঙ্গে বন্ধুত্ব করবে না। শান্তিনিকেতনের অধ্যাপকেরাও অপমানিত বোধ করবেন। যে কোনও পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া চাই, মিশে যাওয়া চাই সেখানকার মানুষজনের সঙ্গে। জওহরলাল লেখেন সে চিঠিতে তাঁর মতে পড়াশোনা করার সময় পড়ুয়াদের কারখানার শ্রমিকদের মধ্যে কিছুদিন থাকা উচিত। এতে শ্রম ও বাস্তব সম্বন্ধে ধারণা হবে। এমন ব্যবস্থা যখন করা যাচ্ছে না তখন শান্তিনিকেতনের আশ্রমজীবনের কঠোরতার মধ্যে কিছুদিন দিনযাপন করুক ইন্দিরা। ইন্দিরা বাবার কথার অবাধ্য হওয়ার মেয়ে অবশ্য নয়। সাধারণ শাড়ি পরে খালিপায়ে শান্তিনিকেতনের সহপাঠীদের সঙ্গে সহজেই মিশে গেল সে। নিজের ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে সুযোগ থাকলেও কখনও গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের দ্বারস্থ হয়নি। শান্তিনিকেতনের বড় মেয়েদের দল নতুনদের খুব একটা পাত্তা দিত না। তাতে কী! ইন্দিরা নতুনদের সঙ্গে দল বেঁধে থাকে। এমনিতে সে লাজুক, খুব একটা বকবক করার অভ্যেস তার নেই। তবে বন্ধুত্বে ভরপুর। ত্রিবেণীতে সদলে ঘুরতে গেল তারা। গঙ্গার তীরে পুরনো মন্দির ইন্দিরার খুব ভাল লেগেছিল। জওহরলালকে উচ্ছ্বসিত চিঠি লেখে সে।

Advertisement

এই যে সহজ সাবলীল ইন্দিরা, সে তো অতীতের— ১৯৬৭ সালে সমাবর্তনে যিনি ভাষণ দিচ্ছেন তিনি তো ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী। তবু শান্তিনিকেতনে আম্রকুঞ্জে এলেই যেন কোথাও তাঁর নিজের সঙ্গে নিজের কথা বলার অবকাশ তৈরি হয়। দেশনায়কের ভেতর থেকে উঁকি মারে মানুষ ইন্দিরা। জওহরলাল যখন আসতেন শান্তিনিকেতনের সমাবর্তনে তখন পুত্র সঞ্জয়কে নিয়ে আসতে হত ইন্দিরাকে। একবার একটু দেরি হয়েছে, বাবা মঞ্চে চলে গেছেন। ইন্দিরা সঞ্জয়কে নিয়ে ভিড়ের মধ্যে পেছনে। পুরনো সহপাঠিনী ইন্দিরাকে দেখে বলে এগিয়ে যেতে। ইন্দিরা নারাজ। বাবা যদি দেখেন ইন্দুর দেরি হয়েছে সমাবর্তন মঞ্চের কাছাকাছি আসতে তাহলে বকুনি খেতে হবে। কে আর বকুনি খেতে চায় । ১৯৬৭ সালের সেই সব দিন অতীত। গুরুদেব তো দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই চলে গেছেন। বাপু নিহত হয়েছেন স্বাধীনতার পর। পিতা জওহরলালের প্রয়াণ হয়েছে ৬৪ সালের মে মাসে । শান্তিনিকেতন থেকে সুধীরঞ্জন দাস ইন্দিরাকে সে-সময়ে শোকবার্তা পাঠান। শান্তিনিকেতনে যখন এলেন ইন্দিরা তার মাসখানেক আগে অনিল চন্দ্রকে চিঠিতে নিজের মেয়ে সম্বন্ধে কয়েকটা কথা লিখে পাঠিয়েছিলেন স্নেহশীল পিতা। লিখেছিলেন শান্তিনিকেতনের শিক্ষা যেন ইন্দিরাকে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সহায়তা করে, নিজের পায়ে যেন দাঁড়াতে পারে সে। পারিবারিক জীবনযাত্রা থেকে মানুষের সেবা করা নিয়ে অগোছালো কিছু ভাবনা উঁকি দেয় তার মেয়ের মাথায়। রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠানে সেই ইচ্ছা যেন সুদৃঢ় ভিত্তি পায় । ’৬৭ সালে তো আর পিতার ছায়া নেই । তাই আম্রকুঞ্জে সেদিনের সমাবর্তন ভাষণের শুরুতে বাংলায় বলেন ইন্দিরা, ‘‘বাংলাদেশে এখন যা ঘটছে তাতে আমি অত্যন্ত ব্যথিত। শঙ্কিত হয়েছি বলব। এই আম্রকুঞ্জে আজকের এই পরিবেশে এ জাতীয় অনুভব না হওয়ারই কথা। কিন্তু আমরা যে অত্যন্ত উত্তেজিত।’’ রাজনৈতিক উত্তেজনার মোকাবিলা করার জন্য ইন্দিরা ফিরে যেতে চান রবীন্দ্রনাথের কাছে– তাঁর মতে রবীন্দ্রনাথও রাজনৈতিক উত্তেজনাকে সমাধান বলে মনে করতেন না। ইন্দিরা গণতন্ত্রের আদর্শকে সেদিনের সমাবর্তনে ব্যাখ্যা করতে চান । বলেন, ‘কেবল স্রোতধারাই তো নদী নয়, নদীতীর নদীকে নদী করে তোলে।’ উপমার যুক্তি রবীন্দ্রনাথের ভাষাভঙ্গিকে মনে করিয়ে দেয়। ১৯৬৯ সালের সমাবর্তন ভাষণে কথাগুলি আরও বিস্তার পেল। ইন্দিরা বললেন, ‘দুটো প্রসঙ্গ এখন মানুষের সামনে বড় হয়ে উঠেছে। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান, অসামঞ্জস্য তীব্র আকার নিচ্ছে। শান্তি বনাম সন্ত্রাসের লড়াই প্রবল হয়ে উঠছে। দ্বিতীয় উপসর্গটি প্রথমটির সঙ্গে সম্পর্কিত।’ এই শান্তির সঙ্গে সন্ত্রাসের লড়াইয়ে ছাত্রদের ভূমিকা কী? ইন্দিরা বললেন, ‘কলকাতার একদল ছাত্র সন্ত্রাসকেই পথ বলে মনে করে– এ খবরে তিনি শঙ্কিত।’ সমকালীন রাজনৈতিক চেহারার প্রেক্ষাপটে আবার তিনি ফেরেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। গুরুদেবও দরিদ্রদের উন্নয়ন চেয়েছিলেন।

শান্তিনিকেতনের সমাবর্তনে যে ইন্দিরাকে আমরা দেখি সেই ইন্দিরা দিল্লির রাজনৈতিক অলিন্দের ইন্দিরা নন। রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে তাঁর নানা সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার যে আস্ফালন চোখে পড়ে শান্তিনিকেতনের আম্রকুঞ্জের ভাষণে সে আস্ফালন নেই। বরং আদর্শের সঙ্গে বোঝাপড়া আছে। ইন্দিরা যখন রবীন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে গেল তার অসুস্থ মায়ের সঙ্গে বিদেশে তখন সেই ছেড়ে যাওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ইট ইজ উইথ অ্যা হেভি হার্ট উই বেড ফেয়ারওয়েল টু ইন্দিরা, ফর সি ইজ সাচ অ্যান অ্যাসেট ইন আওয়ার প্লেস।’ ইন্দিরা শান্তিনিকেতনের সম্পদ একথা লেখেন যখন কবি তখন তিনি সেই মেয়েটির মধ্যে দেখেছিলেন নানা সম্ভাবনা। আর শান্তিনিকেতনের সেই দিনগুলোর কথা হয়তো কখনও ভুলতে পারেন না ইন্দিরা। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি ও আদর্শ শান্তিনিকেতনের সজল মেঘের মতো ভেসে ভেসে আসে তাঁর মনে।

প্রখর রাজনৈতিক বিতর্কে, ক্ষমতার অলিন্দে ইন্দিরা ক্রমশ একা। আর তাঁর মধ্যে শান্তিনিকেতন ছায়াঘন এক পরিসর। সেখানে কবির স্মৃতির কাছে এসে বসেন দেশনায়ক।কবির সঙ্গে কথা বলে নিজের রাজনীতিকে নতুন করে সাজাতে চান। সব সময় পারেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন