মশাল মিছিল। কানহাইয়া কুমারের মুক্তি-সহ ক্যাম্পাসে গেরুয়া সন্ত্রাস বন্ধের দাবিতে মঙ্গলবার পা মেলালেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় দু’শো ছাত্রছাত্রী। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁরা হাঁটেন যাদবপুর থানা পর্যন্ত। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল
বিকেলে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় (বিএইচইউ) ক্যাম্পাসের রাস্তায় হাঁটছিলেন ওঁরা। হঠাত্ কোথা থেকে এসে গা ঘেঁষে থামল একটা মোটরবাইক। দু’জন ছিল বাইকে। পানের পিক ফেলে এক জন বলল, ‘‘দেশ কে খিলাফ বোলনা যাদবপুর কা আদত হ্যায় ক্যয়া? (দেশের বিরুদ্ধে বলা যাদবপুরের স্বভাব নাকি?)’’
মুহূর্তের বিস্ময় কাটতেই ওঁরা বুঝতে পারলেন, টি-শার্টগুলোই চিনিয়ে দিয়েছে ওঁদের! বেনারসে ওঁরা ১১ জন গিয়েছিলেন আন্তঃ-বিশ্ববিদ্যালয় হ্যান্ডবল প্রতিযোগিতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের টিমের সদস্য হয়ে। সচরাচর যেমন হয়, খেলোয়াড়দের টি-শার্ট বা জাম্পারের পিঠে লেখা থাকে টিমের নাম। ওঁদের টি-শার্টের পিছনেও বড় বড় করে লেখা ছিল ‘যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়’। তাই সহজেই চিনে ফেলা এবং হুমকি!
তারিখটা ছিল ১৭ ফেব্রুয়ারি। ঠিক তার আগের দিনই জেএনইউয়ের সমর্থনে যাদবপুরের মিছিল থেকে ‘দেশবিরোধী’ স্লোগান উঠেছিল বলে অভিযোগ। আফজল গুরুর সমর্থনে পোস্টারও পড়েছিল। ১৭ তারিখে একদল যুবক জাতীয় পতাকা হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ে সেই পোস্টার ছিঁড়ে দেয়। কিন্তু এ সবের জের যে বেনারসে গিয়ে পড়বে, ভাবতে পারেননি ওই ১১ জন হ্যান্ডবল খেলোয়াড়। আরও ২৪ ঘণ্টা বিএইচইউ ক্যাম্পাসে ছিলেন ওঁরা। সেই সময়টুকু ‘যাদবপুর’ লেখা টি-শার্টগুলো আর পরেননি। কিন্তু বিলক্ষণ বুঝেছিলেন, ক্যান্টিনে, হস্টেলে, রাস্তায় এমনকী খেলার মাঠেও টানা নজরদারি চলছে ওঁদের উপরে।
এই প্রচণ্ড মানসিক চাপের মাসুল দিতে হয়েছে টুর্নামেন্টেও। বেনারস থেকে হেরে ফিরেছে যাদবপুরের টিম। তবুও শেষ পর্যন্ত ভালয় ভালয় কলকাতা যে ফিরে আসা গিয়েছে, তাতেই যেন খেলোয়াড়েরা স্বস্তিতে। যদিও ভয় পুরোপুরি কাটেনি। ক’দিন আগে খোদ উপাচার্যের বিরুদ্ধে বিজেপি নেতারা যে ভাষায় তোপ দেগেছেন, তা দেখে নিজেদের নাম প্রকাশের সাহসই পাচ্ছেন না ওঁরা। বিএইচইউ-এর ঘটনা নিয়ে মঙ্গলবার যাদবপুরের রেজিস্ট্রার প্রদীপকুমার ঘোষের কাছে রিপোর্ট জমা দিয়েছেন ডিরেক্টর অব ফিজিক্যাল ইন্সট্রাকশন অপরূপ কোনার। যদিও বিএইচইউ-এর কাছে যাদবপুরের তরফে সরকারি ভাবে এখনও অভিযোগ করা হয়নি। রেজিস্ট্রার বলেছেন, ‘‘বুধবার আমি ওই সব খেলোয়াড় এবং দলের ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলব। তখন পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করব।’’
এক খেলোয়াড়ের মতে, এ ভাবে স্রেফ নজরবন্দি করে মানসিক চাপে ফেলে দেওয়ার ঘটনা এত দিন বইয়ে পড়েছেন তিনি। এ বার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হল। তাঁর কথায়, ‘‘যেখানেই যাচ্ছিলাম, দেখছিলাম কয়েক জন লোক ‘ফলো’ করছে। কেউ কেউ আবার এগিয়ে এসে জানতে চাইত, কোন ডিপার্টমেন্টে পড়ি, কোথায় থাকি। আর জানতে চাইত যাদবপুরের মিছিল নিয়ে। কারা মিছিল করেছিল, কারা স্লোগান দিয়েছিল— সব জানতে চাইত!’’ আর এক খেলোয়াড় বলছিলেন, ‘‘ওদের কথাবার্তার ধরন দেখেই ভয় লাগত। ওরা বলেছিল, যাদবপুর দেশদ্রোহীওকা আখাড়া হ্যায়, সব স্টুডেন্টলোগ দেশদ্রোহী হ্যায়!’’
এই হুমকি-নজরদারির কথা স্পোর্টস ম্যানেজার দীপ পালকে সঙ্গে সঙ্গে জানান খেলোয়াড়েরা। দীপবাবু সবাইকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম লেখা জামা পরে বেরোতে বারণ করেন। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘মনে হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্সি পরে বেরোলে পড়ুয়াদের সহজেই চিহ্নিত করা যাবে। ভিন্ রাজ্যে গিয়ে বিপদ এড়াতে প্রাথমিক ভাবে এই পদক্ষেপ করাই উচিত মনে হয়েছিল।’’ বিএইচইউ কর্তৃপক্ষকে কেন বিষয়টি জানালেন না? দীপবাবুর জবাব, ‘‘কর্তৃপক্ষকে জানানোর মানেই হল, আরও বিশেষ ভাবে চিহ্নিত হয়ে যাওয়া। যারা এই ভাবে খোঁজখবর চালাচ্ছিল, তাদের থেকে নিজেদের লুকিয়ে রাখাটাই তখন শ্রেয় মনে হয়েছিল।’’
কিন্তু হুমকি দেওয়া লোকগুলো কারা? তারা কি অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের (এবিভিপি) সদস্য? খেলোয়াড়েরা বলছেন, ‘‘তা বলতে পারব না। তবে যারা প্রশ্ন করছিল, তারা অনেকেই মাঝবয়সি। তাদের গলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্রও ছিল না। কাজেই এরা আদৌ ছাত্র কি না, তা নিয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েছে।’’
আর রয়েছে উৎকণ্ঠা। এক সপ্তাহ পেরোতে চললেও তাড়া করছে বিএইচইউ-এর স্মৃতি।