জেহাদিদের টানতেই জইশে এত প্রেম

উরির সেনাঘাঁটিতে হামলার ঠিক এক সপ্তাহ আগের কথা। কাশ্মীর উপত্যকায় সাত মিনিটের একটি ভিডিও ছড়িয়ে দেয় জইশ-ই-মহম্মদ। ভিডিওয় কাশ্মীরের রাজনীতিক ও ভারতের ‘নিরাপত্তা বাহিনীর চর’-দের ‘শেষ হুঁশিয়ারি’ দিয়ে বলা হয়, সকলের নাম-ঠিকানা জইশের কাছে রয়েছে। কেউ নিস্তার পাবে না।

Advertisement

প্রেমাংশু চৌধুরী

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২১ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৩:২২
Share:

মাসুদ আজহার

উরির সেনাঘাঁটিতে হামলার ঠিক এক সপ্তাহ আগের কথা। কাশ্মীর উপত্যকায় সাত মিনিটের একটি ভিডিও ছড়িয়ে দেয় জইশ-ই-মহম্মদ। ভিডিওয় কাশ্মীরের রাজনীতিক ও ভারতের ‘নিরাপত্তা বাহিনীর চর’-দের ‘শেষ হুঁশিয়ারি’ দিয়ে বলা হয়, সকলের নাম-ঠিকানা জইশের কাছে রয়েছে। কেউ নিস্তার পাবে না।

Advertisement

ফাঁকা আওয়াজ বলে উড়িয়ে দিতে পারেননি গোয়েন্দা বাহিনীর কর্তারা। গত চার-পাঁচ বছর ধরেই ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার রিপোর্ট বলছিল, নতুন করে জইশ-ই-মহম্মদকে জাগিয়ে তুলছে পাকিস্তানি সেনা ও আইএসআই। চলতি বছরের গোড়ায় পঠানকোট বায়ুসেনা ঘাঁটিতে হামলার পর এ বার উরির সেনাঘাঁটির হামলা প্রমাণ করে দিল, সেই রিপোর্ট ভুল ছিল না। সরাসরি সামরিক ঘাঁটিতে দু’টি হামলা প্রমাণ করে দিয়েছে, মৌলানা মাসুদ আজহারের জইশ-ই এখন ভারতের বিরুদ্ধে পাক সেনা ও আইএসআই-এর আসল হাতিয়ার।

কিন্তু কেন?

Advertisement

ভারতীয় এক গোয়েন্দা কর্তার বিশ্লেষণ, জইশ চেয়ারম্যান মাসুদ আজহার দাবি করে, ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করাই তার নীতি এবং কাশ্মীরের জেহাদ তার অঙ্গ। ‘হাজার ক্ষত’ দিয়ে ভারতের রক্ত ঝরানোর লক্ষ্য পূরণই হোক কিংবা আফগানিস্তানের সরকারকে পঙ্গু করে দেওয়া— দুই কাজেই দরকার প্রচুর জেহাদি। জইশ সেই জেহাদিদের জোগানদার। পাকিস্তানের এত মাসুদ-প্রীতির এটা একটা বড় কারণ। তা ছাড়া, তালিবানের সঙ্গে আজহারের যোগাযোগ দীর্ঘদিনের। সে কারণেও আইএসআইয়ের কাছে তার যথেষ্ট দাম রয়েছে। জেনারেল পারভেজ মুশারফের জমানায় জেহাদিদের যে অংশ পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি বিমুখ হয়ে পড়েছিল, তাদের কাছে টানতে পারলে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে। সেই কাজেও মাসুদের জইশ-এই ভরসা রাখছে পাক সেনা-আইএসআই জুটি।

পঠানকোট বা উরিতে হামলার চক্রী হিসেবে নয়, এই মাসুদ আজহার ভারতের কাছে দীর্ঘদিনের এক যন্ত্রণা। তার নাম শুনলেই বিজেপি নেতারা স্পর্শকাতর হয়ে পড়েন। কন্দহর বিমান অপহরণ কাণ্ডে একেই ছেড়ে দিয়েছিল বাজপেয়ী সরকার। তার দু’বছরের মাথায়, ২০০১ সালে ১৩ ডিসেম্বর সংসদে হামলা হয় এই আজহারেরই পরিকল্পনাতে। সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলা নিয়ে বিতর্কে বিজেপিকে অস্বস্তিতে ফেলতে এই ঘটনা এখনও কংগ্রেসের সেরা হাতিয়ার।

ঘটনাচক্রে, সংসদে হামলার বছরেই জইশ দু’টুকরো হয়ে যায়। পাক প্রেসিডেন্ট তখন পারভেজ মুশারফ। তিনি আফগানিস্তান থেকে তালিবানি শাসন উৎখাত করতে আমেরিকাকে সাহায্য করছেন। ইসলামি সংগঠন জইশ ও আফগান তালিবান— উভয়েই দেওবন্দ-অনুসারী। পাক তালিবানের সঙ্গে এদের সম্পর্ক বরাবরই ঘনিষ্ঠ। আইসি-৮১৪ বিমান ছিনতাই, তালিবানি ঘাঁটি কন্দহরে সেই বিমান নামানো ও আজহারের মুক্তি—সবেতেই জইশকে সাহায্য করেছিল তালিবান। মুশারফ আফগানিস্তানে তালিবানি শাসন উৎখাতে আমেরিকার সঙ্গ নেওয়ায় জইশ-এর অন্দরে বিবাদ শুরু হয়— তারা পাকিস্তানি রাষ্ট্রের প্রতিই দায়বদ্ধ থাকবে নাকি মুশারফের বিরুদ্ধে যাবে। মাসুদ আজহার আইএসআই-এর প্রতিই বিশ্বস্ত থেকে যায়। কিন্তু জইশের একাংশ মুশারফকে খুনের ছক কষে। পাক সেনা এর পরে জইশ-এর বিরুদ্ধে কড়া হতে শুরু করে। তাদের কাজকর্ম প্রায় বন্ধ করে দেওয়া হয়।

কিন্তু এখন সময় পাল্টেছে। ওই ভারতীয় গোয়েন্দা কর্তাটির বক্তব্য, ‘‘আইএসআই-এর অধিকাংশ কর্তাই এখন মনে করেন, মুশারফ তালিবানের বিরুদ্ধে আমেরিকাকে সাহায্য করে ভুল করেছিলেন। ফলে অনেক জেহাদি পাকিস্তান-বিরোধী হয়ে উঠেছিল। পাকিস্তানে বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী হামলার অন্যতম কারণ সেটা। এখন তাই জইশের মাধ্যমে সেই জিহাদিদের দলে টেনে ভারত ও আফগানিস্তানের বিরুদ্ধে কাজে লাগাতে চাইছে পাক সেনা এবং আইএসআই।’’ এতে দু’টি লাভ। এক, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা। দুই, ভারত-আফগানিস্তানকে বিপদে ফেলা।

সে কারণে মাসুদের জইশ সব রকম সুযোগ-সুবিধা ও প্রশ্রয় পেয়ে চলেছে পাকিস্তানে। পাক পঞ্জাবের বাহওয়ালপুরে ১৬ একর জুড়ে জইশ-এর সদর দফতর, জঙ্গি-প্রশিক্ষণ শিবির গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে আইএসআই। পাকিস্তান ও আরবের দেশগুলি থেকে জইশ-এর আল-রহমত ট্রাস্টের জন্য টাকা তোলা ও পত্রপত্রিকা ছাপিয়ে প্রচার করতে দেওয়া হচ্ছে। সেই অর্থেই জেহাদিদের পরিবারের জন্য পেনশন জোগায় জইশ। ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, জইশ-এর হাতে এখন অন্তত ৫০০ প্রশিক্ষিত জেহাদি রয়েছে। তার জোরেই লস্কর-ই-তইবার পাশাপাশি জইশ-ই-মহম্মদ এখন ভারতের জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন