‘স্বর্গকে যারা নরক করল, তাদের ক্ষমা নেই’

সুচরিতা বললেন, ‘‘রাত দু’টোয় নিশ্চিন্তে হেঁটে ধাবায় গিয়ে চা খেয়েছি। কোনও দিন মনে হয়নি তো যে কোথাও বিপদ ওত পেতে বসে আছে।’’

Advertisement

গার্গী গুহঠাকুরতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ জানুয়ারি ২০২০ ০৩:২৭
Share:

অধ্যাপিকা সুচরিতা সেন।

‘‘ক্ষমা করা কঠিন। এই স্বর্গীয় জায়গাকে আতঙ্কের নরকে পরিণত করল যারা, তারা ক্ষমার অযোগ্য।’’

Advertisement

রবিবার সন্ধ্যায় জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে মুখোশধারী গুন্ডাদের হামলায় আহত ভূগোলের অধ্যাপিকা সুচরিতা সেন মঙ্গলবার ফোন তুলে প্রথমেই এ কথা বললেন। সে দিন গুন্ডাদের ছোড়া আধলা ইটে তাঁর মাথা ফেটে গিয়েছে। সেলাই পড়েছে ক্ষতে। শরীর জুড়ে ব্যথা। কিন্তু সেই টাটকা ক্ষতের বেদনাও ততটা নয়। যে বেদনা রাগ হয়ে ঝরছে তাঁর গলায়, সে বেদনা তাঁর প্রিয় ক্যাম্পাসকে ঘিরে। দু’দশকেরও বেশি সময় যে ক্যাম্পাসকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রয়েছে তাঁর জীবন, সেই ক্যাম্পাসে একলা হাঁটতে এই প্রথম ভয় পেয়েছেন তিনি। এত দিনের চেনা ‘স্বর্গ’ যারা এক লহমায় ‘আতঙ্কের রাজত্বে’ বদলে দিল, তাদের ক্ষমা করবেন কী করে ?

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এক সময়ে ছাত্রীও ছিলেন। তখন রাত পর্যন্ত পড়াশোনা করে এক কাপ চা খেতে হস্টেল ছেড়ে নির্দ্বিধায় বেরিয়েছেন। সুচরিতা বললেন, ‘‘রাত দু’টোয় নিশ্চিন্তে হেঁটে ধাবায় গিয়ে চা খেয়েছি। কোনও দিন মনে হয়নি তো যে কোথাও বিপদ ওত পেতে বসে আছে।’’ এই ‘নিশ্চিন্ত ভাব’ এক রাতে উধাও হয়ে যাওয়ার ক্ষতের ব্যথা হয়তো আজীবন পিছু ছাড়বে না। আর সেটাই ঘুরে ফিরে আসছে তাঁর কথায়।

Advertisement

তবে হার মানার প্রশ্নই নেই। ওই ব্যথা, ওই ‘ট্রমা’ সঙ্গী করেই সুচরিতা ফিরবেন তাঁর প্রিয় ক্যাম্পাসে। কারণ খুব সোজা। এটাই তো তাঁর বাড়ি। এখানেই তাঁর মুক্ত ভাবনা শিকড় গেঁথেছে। যে ভাবনা ডালপালা ছড়িয়েছে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের মননেও। তাই কলকাতার পাঠভবন স্কুলের একদা চুপচাপ ছাত্রী শান্ত অথচ দৃঢ় স্বরে বলেন, ‘‘অবশ্যই ফিরব। এটা আমাদের জায়গা। এ জায়গা আবার আমাদের হবে। উই আর গোয়িং টু রিক্লেম দ্য স্পেস।’’ আগামী শনিবার সেলাই কাটা হবে। রবিবারই ক্যাম্পাসে ফিরবেন বলে জানালেন তিনি। এবং ফিরে এসে যা করতেন তা-ই করবেন। যে ভাবে ক্যাম্পাসে অন্যায় নীতির বিরোধিতা করছিলেন, এই হামলার পরেও তাতে ছেদ পড়বে না বলে জানিয়ে দিলেন সুচরিতা।

রবিবারের হামলার ঘটনা বলতে গিয়ে সুচরিতা একটা কথা স্পষ্ট জানালেন। তাঁর অভিযোগ, এই হামলা পরিকল্পিত ভাবেই করা হয়েছে। না হলে বেছে বেছে কয়েক জনকেই কেন নিশানা করা হল? তিনি বলেন, ‘‘সে দিন পড়ুয়াদের উপরে আঘাত আসবে ভেবে আমরা মহিলা শিক্ষকরা মানববন্ধন গড়তে যাচ্ছিলাম। তখনই বৃষ্টির মতো ইট পড়তে শুরু করল। আমার কাঁধে লাগল। মাথা ফাটল। আরও ভয়ানক কিছু হতে পারত। আমি পড়ে গিয়েছিলাম বলে বেঁচে গিয়েছি।’’ ঘটনার দু’দিন পরে মঙ্গলবার অভিযোগ দায়ের করেছেন। ঘটনার যথাযথ তদন্ত দাবি করেছেন। যদিও সেই তদন্তে কতটা কী হবে, তা নিয়ে বিশেষ ভরসা রাখতে পারছেন না। তিনি বলেন, ‘‘সরকারি ব্যবস্থায় আস্থা নেই আর।’’

কোথায় তাঁর আস্থা নড়েছে, তা স্পষ্ট পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগেই। সেখানে তিনি জানিয়েছেন, সাধারণত বহিরাগত কাউকে ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেওয়া হয় না। সে ক্ষেত্রে এত জন
মুখোশধারী লাঠি, লোহার রড, পাথর নিয়ে কী করে জড়ো হল ক্যাম্পাসে? ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা প্রধানকে জানানো হলেও তিনি কোনও পদক্ষেপ করেননি।

তাঁর আস্থার জায়গা এখন সাধারণ নাগরিক। এই গুন্ডামির প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মিছিল, সমাবেশ হচ্ছে। এই গর্জে ওঠাই তাঁকে সাহস জোগাচ্ছে। ভরসা দিচ্ছে। সুচরিতা বলেন, ‘‘কত ছাত্র-ছাত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল না। তাঁরাও খোঁজ নিচ্ছেন। আমার ছোটবেলার শহরেও দেখলাম একের পর এক প্রতিবাদ সভা, মিছিল হচ্ছে। এই শুভ বুদ্ধিই ভরসা দিচ্ছে।’’ আত্মীয়-বন্ধুরা তাঁকে ঘিরে রেখেছেন। নিজের মেয়ে বিদেশ থেকে আসছেন শনিবার। মায়ের আপত্তি উড়িয়েই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন