জবাব দেবেন বসুন্ধরাই, দূরত্ব বাড়াচ্ছে বিজেপি

মোটের উপর সুষমা স্বরাজের পাশে দাঁড়িয়েছে দল ও সরকার। বসুন্ধরা রাজে কিন্তু কার্যত এক ঘরে। ললিত মোদী কাণ্ডে বিজেপির বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়ে গত কাল রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর নাম জড়িয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানতে পারবেন না, এই শর্তে ২০১১ সালে ব্রিটেনে ললিত মোদীর অভিবাসন আবেদনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তিনি। ললিত মোদীর আইনজীবীই এমন নথি তুলে দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমের হাতে। যদিও সেই নথিতে কারও সই নেই এবং বসুন্ধরা এমন কোনও নথির অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন, তবু তাঁর সমর্থনে আজ মুখ খোলেননি বিজেপির শীর্ষ কোনও নেতাই।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৫ ০৩:৩০
Share:

মোটের উপর সুষমা স্বরাজের পাশে দাঁড়িয়েছে দল ও সরকার। বসুন্ধরা রাজে কিন্তু কার্যত এক ঘরে।

Advertisement

ললিত মোদী কাণ্ডে বিজেপির বিড়ম্বনা আরও বাড়িয়ে গত কাল রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর নাম জড়িয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানতে পারবেন না, এই শর্তে ২০১১ সালে ব্রিটেনে ললিত মোদীর অভিবাসন আবেদনের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন তিনি। ললিত মোদীর আইনজীবীই এমন নথি তুলে দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমের হাতে। যদিও সেই নথিতে কারও সই নেই এবং বসুন্ধরা এমন কোনও নথির অস্তিত্ব অস্বীকার করেছেন, তবু তাঁর সমর্থনে আজ মুখ খোলেননি বিজেপির শীর্ষ কোনও নেতাই।

বিজেপি সূত্র বলছে, বিতর্ক সামনে আসার পর গত কালই দিল্লি এসে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে চেয়ে সভাপতি অমিত শাহের কাছে সময় চেয়েছিলেন বসুন্ধরা। অমিত সময় দেননি। এর পর টেলিফোনেই আত্মপক্ষ সমর্থন করেন রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী। অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ মহল বলছে, সব শোনার পরে বিজেপি সভাপতি বসুন্ধরাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, যাবতীয় অভিযোগের জবাব তাঁকেই দিতে হবে। দল কোনও কথা বলবে না। আর তাই সুষমা স্বরাজের হয়ে রবিশঙ্কর প্রসাদ, অরুণ জেটলির মতো হেভিওয়েট নেতারা মুখ খুললেও (জেটলি অবশ্য গত কাল কৌশলে দায় সুষমার উপরেই চাপিয়েছেন) বসুন্ধরার জন্য আসরে কেউ নেই!

Advertisement

কেন? বিজেপি সূত্রের বক্তব্য, সুষমা মানবিকতার খাতিরে ললিত মোদীর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন, এমন যুক্তি তুলে ধরা যাচ্ছে। কিন্তু ব্যবসায়িক স্বার্থে বসুন্ধরা ললিতের সঙ্গে এমন ওতপ্রোত ভাবে জড়িত যে, তাঁকে বাঁচানোর চেষ্টা করলে দলেরই মুখ পুড়তে পারে। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের (ইডি) তদন্তই বলছে, ২০০৮ সালে বসুন্ধরার মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম পর্বে ললিত মোদীর সংস্থা আনন্দ হেরিটেজ হোটেলে প্রায় ২১ কোটি বিনিয়োগ করে মরিশাসের একটি বেনামি সংস্থা। যার মধ্যে প্রায় ১১.৬৩ কোটি টাকা হাত বদল হয়ে পৌঁছয় বসুন্ধরার পুত্র তথা রাজস্থানের ঝালওয়ারের বিজেপি সাংসদ দুষ্মন্ত সিংহের মালিকানাধীন নিয়ন্ত হেরিটেজ হোটেলের অ্যাকাউন্টে। তদন্তে জানা গিয়েছে, ঋণশোধ ও শেয়ারের দাম মেটানো বাবদ ললিত ওই টাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু ইডির বক্তব্য, দুষ্মন্তের সংস্থাকে ঘুরপথে আর্থিক ফায়দা পাইয়ে দিতে শেয়ারের দাম কয়েকশো গুণ বাড়িয়ে দেখানো হয়েছিল।

এখানেই শেষ নয়। পর্তুগালে যে হাসপাতালে ললিতের স্ত্রী মিনালের ক্যানসারের চিকিৎসা হয়েছে, সেই হাসপাতালকে জয়পুরের হেল্থ সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ৩৫ হাজার বর্গফুট জমি দেয় বসুন্ধরার সরকার। গত ২ অক্টোবর লিসবনে এই মউ স্বাক্ষর হয়। যার জন্য পর্তুগাল উড়ে গিয়েছিলেন বসুন্ধরা। আগামী বছরের মধ্যে ওই জমিতে ১২০ শয্যার হাসপাতাল গড়ে ওঠার কথা। বিরোধীরা গোটা বিষয়টিতে ললিত-বসুন্ধরা সম্পর্কের ছায়া দেখলেও রাজস্থানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রাজেন্দ্র সিংহের অবশ্য দাবি, ‘‘ললিত মোদীর স্ত্রী যে ওই হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন, সে বিষয়ে আমাদের কাছে কোনও তথ্য ছিল না।’’ যদিও ললিত নিজেই গত কাল বলেছেন, ২০১২-’১৩ সালে তাঁর স্ত্রীকে ওই হাসপাতালে ভর্তি করান বসুন্ধরাই।



সবিস্তার জানতে
ক্লিক করুন।

বসুন্ধরাকে ঘিরে এই সব জটিলতার কারণেই আজ রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, ‘‘রাজস্থানের বিষয়টি তদন্তসাপেক্ষ। বসুন্ধরা রাজে কাল এ বিষয়ে অল্প হলেও মুখ খুলেছিলেন। আমি মনে করছি আগামী দিনে তিনিই এর জবাব দেবেন।’’ বিজেপির অন্য একটি অংশের বক্তব্য, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বসুন্ধরার সম্পর্ক মোটেই ভাল নয়। তার উপর এত অভিযোগ। তাই গোটা বিষয়টি নিয়ে গা বাঁচিয়ে চলছে মোদী সরকার। সেই কারণেই গত কাল ললিত ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সাহায্যকারী হিসেবে ইউপিএ আমলের তিন মন্ত্রী শরদ পওয়ার, প্রফুল্ল পটেল ও রাজীব শুক্লর নাম করলেও আজ এ নিয়ে সরব হয়নি বিজেপি। রাজীব গত কালই এই অভিযোগ অস্বীকার করেছিলেন। শরদ পওয়ার আজ বলেছেন, গত মাসে লন্ডনে তাঁর সঙ্গে ললিতের দেখা হয়। তিনি ললিতকে দেশে ফিরে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার কথাই বলেছিলেন।

বিজেপি সূত্র বলছে, পওয়ার, শুক্লদের বিরুদ্ধে শুধু ললিতের মুখের কথাই সম্বল। কিন্তু দুই বিজেপি নেত্রীর বিরুদ্ধে, যেমনই হোক, কাগজেকলমে তাঁকে সাহায্য করার প্রমাণ রয়েছে। বিশেষ করে বসুন্ধরা যে চিঠি লিখেছেন বলে অভিযোগ, তা গুরুতর। তাই যদি দেখা যায় যে কেলেঙ্কারিতে বসুন্ধরা আরও জড়িয়ে যাচ্ছেন, তা হলে তাঁকে ইস্তফা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হতে পারে বলেও ওই সূত্রের অভিমত।

বিরোধীরা অবশ্য এখনই সুষমা ও বসুন্ধরার অপসারণ চাইছে। বসুন্ধরার ইস্তফার দাবিতে আগামিকাল গোটা রাজস্থানে বিক্ষোভ দেখাবে কংগ্রেস। পাশাপাশি পি চিদম্বরম আজ চেন্নাইয়ে সাংবাদিক বৈঠক করে বলেছেন, ‘‘সুষমা স্বরাজ যে তাঁর সাংবিধানিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্বজনপোষণ করেছেন, সে ব্যাপারে কোনও সংশয় নেই। তাঁকে ইস্তফা দিতেই হবে।’’

মানবিকতার খাতিরেই ললিতের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সুষমা, এই যুক্তি খারিজ করে চিদম্বরমের বক্তব্য, তা হলে বিদেশমন্ত্রী কেন ওঁকে লন্ডনে ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেননি। তা ছাড়া, ললিতকে কেন শুধু পর্তুগাল যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হল না এবং তিনি ভারতীয় নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও কেন তাঁকে ব্রিটিশ ট্র্যাভেল ডকুমেন্ট দিতে অনুরোধ করা হল, এই প্রশ্নও তুলেছেন চিদম্বরম।

এই বিতর্কের মুখে নরেন্দ্র মোদী অবিলম্বে সুষমাকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দেবেন, এমন আশা অবশ্য কংগ্রেস করছে না। ইয়েদুরাপ্পার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পরেও তাঁকে কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরাতে প্রায় এক বছর সময় নিয়েছিল বিজেপি। তা ছাড়া, এখন সুষমাকে সরিয়ে দিলে সরকারের গায়ে দুর্নীতির দাগ লেগে যাবে। তবে সুষমার থেকে যাওয়াটা আখেরে তাঁদের পক্ষে ভালই হবে বলেই মনে করছেন কংগ্রেস নেতারা। কারণ, যত বেশি দিন এই বিতর্ক জিইয়ে রাখা যাবে, ততই জোরদার হবে দলীয় কর্মীদের মনোবল। সেই লক্ষ্য নিয়েই একেবারে প্রথম দিন থেকে আসরে নেমেছেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী। খোদ প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করেছেন তিনি। গত কাল আক্রমণে নামেন প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী আনন্দ শর্মা। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি সাংবাদিক বৈঠক করেন আনন্দ শর্মার পরে। তাই আজ সনিয়ার নির্দেশে প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী চিদম্বরম জেটলির দেওয়া যুক্তির জবাব দিলেন। দু’-এক দিনের মধ্যে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহও মুখ খুলতে পারেন বলে কংগ্রেস সূত্রে খবর।

চিদম্বরম আজ মোদী সরকারের উপরে চাপ বাড়িয়ে অবিলম্বে ললিত মোদীকে দেশে ফেরানোর দাবি তুলেছেন। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য, ইউপিএ মন্ত্রিসভায় আলোচনার পরে তৎকালীন ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রী জর্জ অসবোর্নকে চিঠি লিখে ললিতকে ভারতে ফেরানোর দাবি জানিয়েছিলেন তিনি। সেই চিঠিতে কাজ না-হওয়ায় আরও কড়া সুরে দ্বিতীয় চিঠি লিখেছিলেন। দেখাও করেছিলেন অসবোর্নের সঙ্গে। অসবোর্নকে লেখা তাঁর চিঠি প্রকাশের দাবির পাশাপাশি ললিতকে দেশে ফেরাতে গত এক বছরে নরেন্দ্র মোদীর সরকার কী করেছে, প্রশ্ন তুলেছেন চিদম্বরম।

গোটা বিষয় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নীরবতাকেও আজ ফের কটাক্ষ করেছে কংগ্রেস। দলের মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালার মন্তব্য, ‘‘প্রধানমন্ত্রী মৌন যোগ করছেন। ওঁর নাম হওয়া উচিত মৌন মোদী।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন