মৃত্যুর মঞ্চে মেলালেন নিজের কথাই

আইআইএম পড়ুয়াদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতার পর সবে কথা শুরু। হঠাৎ দেখলেন, তাঁর ‘স্যর’ পোডিয়াম থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন! ছাত্রদের অপেক্ষায় রাখতে একেবারেই রাজি ছিলেন না দেশের ‘মিসাইল ম্যান’। তাই বিমানে গুয়াহাটি নেমে সড়কপথে শিলং পৌঁছনোর পরই চলে যান আইআইএম-এর মঞ্চে।

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ২৯ জুলাই ২০১৫ ০৩:৫৮
Share:

এ পি জে আব্দুল কালামের মৃত্যুর কিছু ক্ষণ আগে তাঁর সঙ্গে করমর্দন রক্ষী এস এ লাপাংয়ের। সোমবার শিলংয়ে। ছবি সৃজনপাল সিংহের ফেসবুক পেজ থেকে।

আইআইএম পড়ুয়াদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত আলাপচারিতার পর সবে কথা শুরু। হঠাৎ দেখলেন, তাঁর ‘স্যর’ পোডিয়াম থেকে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছেন!

Advertisement

ছাত্রদের অপেক্ষায় রাখতে একেবারেই রাজি ছিলেন না দেশের ‘মিসাইল ম্যান’। তাই বিমানে গুয়াহাটি নেমে সড়কপথে শিলং পৌঁছনোর পরই চলে যান আইআইএম-এর মঞ্চে। বেশ ক্লান্তই ছিলেন। কিন্তু পোডিয়ামে বক্তৃতার সময় তাঁর ‘স্যর’ যে এ ভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বেন, তা ভাবতে পারেননি এ পি জে আব্দুল কালামের ছ’বছরের ছায়াসঙ্গী সৃজনপাল সিংহ।

প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির মরদেহ নিয়ে দিল্লি রওনা দেওয়ার আগে গুয়াহাটি বিমানবন্দরে গত কালের সফরের কথা বলতে গিয়ে গলা বুজে আসছিল সৃজনপালের। তিনি বলেন, ‘‘মঞ্চের মাইক্রোফোন ঠিক করে ওঁর দিকে তাকিয়ে হাসলাম। বরাবরের মতোই উনি বললেন— ‘ফানি গাই, আর ইউ ডুইং ওয়েল?’ ছ’বছর ধরে চেনা ওই কথাটা। শুধু সুর শুনে বুঝতে হবে ওঁর মুড কেমন। উত্তর দিলাম, ‘ইয়েস অল ফিট, গো অ্যাহেড।’ ব্যস। সেটাই আমার সঙ্গে ওঁর শেষ কথা!’’ কালামের তিনটি বইয়ের সহ-লেখক সৃজনপাল বলে চললেন, ‘‘ছাত্রদের সঙ্গে ছোট্ট আলাপচারিতার পর হার্ভার্ড-এমআইটি যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে সবে কথা শুরু করেছেন। হঠাৎ দেখলাম তিনি পোডিয়াম থেকে পড়ে গেলেন। চোখ বন্ধ।’’

Advertisement

হলভর্তি ছাত্র-শিক্ষক, মঞ্চে উপস্থিত লোকজনের মতো হতবাক হয়ে যান সৃজনপালও। ছুটে যান কালামের পাশে। তখন ঘড়িতে সন্ধে ৬টা ৪০। হাসপাতালে নিয়ে যেতে মিনিট পাঁচেক সময় লেগেছিল। সৃজনপালের কথায়, ‘‘কিছু ক্ষণ পরই শুনলাম মৃত্যু-উড়ানে চেপে নতুন জগতে রওনা দিয়েছেন মিসাইল ম্যান।’’

গত কাল বেলা ১২টায় দিল্লি থেকে গুয়াহাটি রওনা দিয়েছিলেন কালাম। সঙ্গে সৃজনপালও। তিনি বলেন, ‘‘বর্ষার আকাশে আড়াই ঘণ্টার উড়ান। খারাপ আবহাওয়ায় বিমানের ঝাঁকুনিতে আমি ভয় পাই। কালাম স্যর আমাকে শান্ত করতে বিমানের জানলার পাল্লা নামিয়ে দিলেন। বললেন— ব্যস, এখন আর ভয়কে দেখতে পাচ্ছ না। তাই ভয় পাওয়ার কারণও নেই।’’

ফেরার বিমানে সেই ‘স্যর’-এর তেরঙ্গা ঢাকা মরদেহ নিয়ে দিল্লি গেলেন সৃজনপাল। তিনি বলেন, ‘‘স্যরের তিনটি বইয়ের সহ-লেখক হিসেবে নয়। সমাজকর্মী বা কর্পোরেট কনসালট্যান্টও নয়, গত কাল থেকে হয়তো আমার একটাই পরিচয় সকলে মনে রাখবেন— এ পি জে আব্দুল কালামের শেষ দিনের ছায়াসঙ্গী!’’ তিনি জানান, গুয়াহাটি থেকে শিলং যাওয়ার রাস্তায় অনেক বিষয় নিয়ে কালামের সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা হয়। পঞ্জাবে জঙ্গি হানা নিয়ে চিন্তিত ছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি। কালামের বক্তব্য ছিল, মানুষের তৈরি কারণই পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। হিংসা, দূষণ ও মানুষের হঠকারি কাজকর্ম যে হারে বাড়ছে তাতে বড়জোর তিরিশ বছর এই দুনিয়ায় থাকা যাবে। সৃজনপালের কথায়, ‘‘তখনও কী জানতাম, মাত্র তিন ঘণ্টা পর বক্তাই পৃথিবী ছাড়তে চলেছেন!’’

সৃজনপাল জানান, শিলং যাওয়ার পথে কালামের চোখ পড়ছিল তাঁর গাড়ির সামনে ‘এসকর্ট’ জিপসিতে মেশিনগান নিয়ে দাঁড়ানো এক জওয়ানের দিকে। তিনি বলেন, ‘‘স্যর বলছিলেন, বেচারা কী এ ভাবে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে? ওয়্যারলেসে খবর পাঠিয়ে ওঁকে বসতে বলতে বলো। নিয়মের ফাঁদে তা করা যায়নি।’’

শিলংয়ে পৌঁছেই ওই জওয়ানের খোঁজ নেন কালাম। তাঁকে ডেকে পাঠাতে বলেন। সৃজনপাল বলেন, ‘‘লম্বা, সুঠাম চেহারার কনস্টেবল এস এ লাপাং স্যরের সামনে দাঁড়িয়ে ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। ওঁকে অবাক করে হাত সামনে এগিয়ে দিলেন স্যর। করমর্দনের পর বললেন— আমার জন্য এতটা পথ আপনাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হল। নিশ্চয়ই ক্লান্ত লাগছে। আমার সঙ্গে বসে চা খেয়ে যান।’’ অবাক হয়ে যান ওই জওয়ান। কিন্তু ভ্যাবাচ্যাকা ভাবটা কাটিয়ে তিনি উত্তর দেন, ‘‘স্যর আপনার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনায়াসে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি।’’ বিকেলে সামান্য জলযোগ চা-পকোড়া খেয়ে আইআইএমের মঞ্চের দিকে এগোন কালাম। এর পরের সময়টাই দ্রুত ভুলতে চান সৃজনপাল। ভুলতে চান, কী ভাবে তাঁর চোখের সামনে ‘স্যর’-এর মৃত্যু হল।

স্বপ্নের মানুষের সঙ্গে হাত মেলানোর আনন্দের রেশ যে এত তাড়াতাড়ি কেটে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবেননি এস এ লাপাং। মেঘালয় পুলিশের সশস্ত্র ব্যাটেলিয়নের কনস্টেবল শুধু বলছেন, ‘‘আমাকে উনি যে সম্মান দিলেন, তার বদলে ভাল করে ধন্যবাদটাও জানাতে পারলাম না।’’

লাপাং ভেবেছিলেন, আইআইএম থেকে বেরনোর পর তিনি প্রাক্তন রাষ্ট্রপতিকে ‘থ্যাঙ্ক ইউ’ বলার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তার আগেই সব বদলে গেল। ওই জওয়ানের কথায়, ‘‘ওঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার কথা সহকর্মীদের বলছিলাম। হঠাৎ অডিটোরিয়াম থেকে চেঁচামেচির শব্দ। আমাদের অফিসার দৌড়ে এসে বললেন— এখনই বেথেনি হাসপাতালে যেতে হবে। দেখলাম একটু আগে যাঁর সঙ্গে হাত মিলিয়েছি, তাঁরই সংজ্ঞাহীন দেহ বের করে নিয়ে আসা হচ্ছে!’’ বেথেনি হাসপাতালে পৌঁছনোর পর তিনি শুনলেন, সব শেষ।

২০০৯ সাল থেকে অনেক ভিভিআইপির কনভয় ‘এসকর্ট’ করেছেন লাপাং। গত কাল প্রথম বার ভিভিআইপি-র ঘর থেকে তাঁর ডাক পড়ল। এ দিন তিনি বলছিলেন, ‘‘ভেবেছিলাম কোনও ভুল করেছি। না হলে প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি আমাকে তলব করবেন কেন! না জানি কী ভাষায় কথা বলবেন! কোন মুখে ক্ষমা চাইব! কিন্ত, ঘরে ঢুকতেই একগাল হেসে আমায় কাছে ডাকলেন স্যর।’’ নিজের চোখ-কানকেই সে সব বিশ্বাস করাতে পারছিলেন না লাপাং।

কিন্তু কালামের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এখন তিনিই যেন ভিভিআইপি। সকলে তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন। কেউ চাইছেন তাঁর ছবি। লাপাং কিন্তু মনমরা। তাঁর কথায়, ‘‘মিনিটখানেকের ওই সাক্ষাৎই হয়তো আমার জীবনের সেরা সুখ ও দুঃখের সময় হয়ে থাকবে।’’

সৃজনপাল বললেন, ‘‘স্যর মাঝেমধ্যেই জিজ্ঞেস করতেন, নিজেকে কী ভাবে স্মরণীয় রাখতে চাও? এক দিন আমিই পাল্টা সেই প্রশ্ন করলাম ওঁকে। বললাম রাষ্ট্রপতি, লেখক, বিজ্ঞানী, মিসাইল ম্যান, ভিশন ইন্ডিয়া ২০২০— কোন কাজের জন্য নিজেকে অমর দেখতে চান? জবাব এল, শিক্ষক হিসেবে।’’ সেটা ছিল দু’সপ্তাহ আগের ঘটনা। সে দিন কালাম সৃজনপালকে বলেছিলেন, ‘‘সেই মানুষই ভাগ্যবান, যে কোনও রোগভোগ ছাড়া, কাজ করতে করতেই মারা যান। শেষ বিদায় হওয়া উচিত সংক্ষিপ্ত।’’

নিজের সেই দু’টো কথাই মৃত্যুর মঞ্চে মিলিয়ে দিয়ে গেলেন এ পি জে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন