রাজনেতাদের আশ্বাসই সার। বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের স্বপ্ন এখনও তা-ই অধবা মাজুলিবাসীর।
২০০১ সালে অগপ সাংসদ অরুণ শর্মা ওই স্বপ্নপূরণে সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে তরুণ গগৈও বলেছিলেন একই কথা। আশ্বাস দিয়েছিলেন মনমোহন সিংহ। কেন্দ্রে পালাবদলের আগে নরেন্দ্র মোদীর মুখেও সেই বক্তব্য শোনা গিয়েছিল। এ বারের বিধানসভা ভোটের সময় মাজুলির বিজেপি প্রার্থী সর্বানন্দ সোনোয়ালও ও সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে গিয়েছিলেন।
কিন্তু দিনবদল হল না এখনও।
সেই নদীদ্বীপের অলিগলিতে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে ক্ষোভের সুর। স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন— প্রতি বার ভোটের আগে বিভিন্ন দলের নেতারা একই প্রতিশ্রুতি দেন। সবাই-ই বলেন, ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের তালিকায় মাজুলির নাম অন্তর্ভুক্ত করেই ছাড়বেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে ও অজুহাতে গত দেড় দশকেও প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি। এ বার বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী সর্বানন্দ লড়াইয়ের কেন্দ্র হিসেবে মাজুলিকে বেছে নেওয়ায় ফের আশায় বুক বেঁধেছিলেন মাজুলিবাসী। ফল যে কে সেই। সম্প্রতি তাঁরা জানতে পারেন, ২০১৬-১৭ সালে ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রে নাম ঢোকানোর জন্য ভারত থেকে যে জায়গাগুলির নাম পাঠানো হয়েছে তাতে নেই মাজুলি। ইউনেসকোর বিচারসভায় ঢুকে নাকচ হলে অন্য কথা, কিন্তু দেশ থেকে পাঠানো তালিকাতেই মাজুলির নাম না থাকায় বিস্মিত মাজুলিবাসী। পড়ে পাওয়া অস্ত্রে বিজেপিকে বিঁধছে কংগ্রেস। কিন্তু বিজেপি পাল্টা দোষ চাপাচ্ছে কংগ্রেসের উপরেই।
এক সময়ে বিশ্বের বৃহত্তম নদীদ্বীপ হিসেবে পরিচিত ছিল মাজুলি। ক্ষয় হতে হতে, পরে এশিয়া ও এখন ভারতের বৃহত্তম নদীদ্বীপ হয়ে থেমেছে মাজুলি। ক্ষয় অবশ্য থামানো যাচ্ছে না। কোনও বাঁধেই কাজ দেয়নি। ক্ষয় রোধ করতে না পারার ফলেই ইউনেসকো জানিয়েছে, বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রে মাজুলির স্থান পাওয়া কঠিন। এমন সমৃদ্ধ, ঐতিহ্যশালী ধর্মীয় ও সংস্কৃতিক্ষেত্র হওয়ায় মাজুলির ঐতিহ্যক্ষেত্র হওয়ায় তেমন বাধা ছিল না। কিন্তু যে দ্বীপের ভবিষ্যতই অনিশ্চিত— তাকে তালিকায় তুলতে নারাজ ইউনেসকো।
১৯৯৮ সাল থেকে মাজুলির নাম বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্রের তালিকার ঢোকানোর জন্য দাবি উঠেছে। ২০০৪, ২০০৬ ও ২০১২ সালে ভারতীয় পুরাত্বত্ত্ব সর্বেক্ষণের (এএসআই) তরফে মাজুলির নাম ইউনেসকোর কাছে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় বিবরণের অভাবে প্রস্তাব খারিজ হয়ে যায়। ২০১৩ সালের সিএজি রিপোর্টে বলা হয়, অনেক টাকা খরচ করে উপদেষ্টা নিয়োগ করার পরও বারবার অসম্পূর্ণ প্রস্তাব তৈরি করা হচ্ছে। সেই কারণেই মাজুলির নাম গণ্য করেনি ইউনেসকো। তাই মাজুলির সত্রীয় সংস্কৃতি, মুখোশ শিল্প, রাস উৎসব, বৈষ্ণব ধর্ম ও সত্র সংস্কৃতির বিশদ বিবরণের পাশাপাশি সংরক্ষণের উপায়, ক্ষয় রোধে নেওয়া ব্যবস্থার উল্লেখ করে নতুন প্রস্তাব পাঠানোর কথা ছিল।
কিন্তু ভারত থেকে পাঠানো তালিকায় মাজুলির জায়গায় আমদাবাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় রাজ্য কংগ্রেস ফুঁসে উঠেছে। কংগ্রেসের মতে, বিজেপি মাজুলি তথা অসমবাসীকে নাগাড়ে মিথ্যা বলে চলেছে। এই ঘটনা তার প্রমাণ। বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতারা মাজুলি নিয়ে চিন্তিত নন। কংগ্রেস মুখপাত্র রিপুন বরা বলেন, ‘‘কেন্দ্রের এই ব্যর্থতার দায় সেখানকার সাংসদ সর্বানন্দ সোনোয়ালকেও নিতে হবে। এই মিথ্যাচার ও অবহেলার নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে এবং অসমের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ করে তাঁর অবিলম্বে পদত্যাগ করা উচিত।’’
উল্লেখ্য, গত বছর ফেব্রুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় জলসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী মাজুলিতে এসে দু’দিন ছিলেন। তিনি আশ্বাস দিয়ে গিয়েছিলেন, মাজুলির নাম ঐতিহ্যক্ষেত্রের তালিকায় ঢোকানোর জন্য তিনি নিজে ব্যবস্থা নেবেন।
কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি।
বিজেপির মুখপাত্র পবিত্র মার্গারিটা অবশ্য দাবি করেছেন, ‘‘২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই কেন্দ্র রাজ্য সরকারকে জানিয়েছিল, ইউনেসকোকে পাঠানোর জন্য মাজুলি নিয়ে নতুন ও বিশদ প্রস্তাবপত্র তৈরি করতে হবে। সে কাজে সাহায্য করবে এএসআই। কিন্তু গত ১৪ মাস ধরে রাজ্য সরকার এ নিয়ে কোনও ব্যবস্থাই নেয়নি। তার ফলেই তালিকায় ঢোকানো যায়নি মাজুলির নাম।’’
বিজেপির দাবি, কেন্দ্রে ও রাজ্যে কংগ্রেস সরকার থাকার সময় তিন দফায় মাজুলি নিয়ে পাঠানো প্রস্তাব খারিজ হয়ে গিয়েছে। বিজেপি কেন্দ্র আসার পর থেকে এ নিয়ে যথেষ্ট উদ্যোগ নিলেও রাজ্য সরকারের অবহেলার ফলেই কাজ এগোল না।
মাজুলির সুপ্রাচীন সত্র আউনিআটির সত্রাধিকার পীতাম্বর দেব গোস্বামী এই ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করে বলেন, ‘‘বছরের পর বছর কোনও না কোনও কারণে মাজুলির দাবি পূরণ হচ্ছে না। ঐতিহ্যক্ষেত্র হওয়ার সব শর্ত পূরণ করার পরেও ইউনেসকো বারবার মাজুলির প্রস্তাব খারিজ করছে।’’
মাজুলির বাসিন্দা পূন্য শইকিয়া, মহেন্দ্র শর্মা, ভূবন পেগু, নুমাল দোলেরা আফশোস করতে করতে ক্লান্ত। মাজুলি বিশ্ব ঐতিহ্যক্ষেত্র হলে ঠিক কী বদল হবে, কতটা উন্নতি হবে, কাদের-কোথায়-কতটা সম্মানবৃদ্ধি হবে তা নিয়ে কারও স্পষ্ট ধারণা নেই। কিন্তু ওই তকমাটা এখন মাজুলির সম্মানের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে। তাঁদের মতে, মাজুলি নিয়ে এ ভাবেই রাজনৈতিক চাপান-উতোর চলতে থাকবে। এর পরেও প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ফের অন্য কোনও নেতার ভুয়ো আশ্বাসে নতুন করে ভরসা রাখবেন মাজুলিবাসী।