‘ভিটেছাড়া করলে দাঁড়াব কোথায়’

মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ায় প্রজন্মবাহিত শ্রুতিকথায় তিনি হয়ে উঠেছেন বনবাসীদের দেবতা। তাঁর মূর্তি এখন পুজো করা হয়।

Advertisement

অগ্নি রায়

খান্ডোয়া (মধ্যপ্রদেশ) শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৯ ০২:৪০
Share:

মধ্যপ্রদেশের গ্রামে সেগুন অরণ্যের রোদে পোড়া চেহারা।

টান্টিয়া মামা তীক্ষ্ণ নজর রাখছেন! জল-জঙ্গল-জমির অধিকার তিনি কিছুতেই কেড়ে নিতে দেবেন না। সিপাহি বিদ্রোহের সময় বনবাসীদের হয়ে রক্তজল করে লড়েছিলেন। ব্রিটিশদের কাছে হয়ে উঠেছিলেন আতঙ্ক। ফাঁসিতে যা শেষ হয়।

Advertisement

মধ্যপ্রদেশের খান্ডোয়ায় প্রজন্মবাহিত শ্রুতিকথায় তিনি হয়ে উঠেছেন বনবাসীদের দেবতা। তাঁর মূর্তি এখন পুজো করা হয়। তিনি এখানকার মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে বারুদ জোগান।

টান্টিয়া মামার মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে যত দূর চোখ যায়, পাহাড় আর সেগুন অরণ্যের রোদে পোড়া কঙ্কালসার চেহারা। ঝরা পাতার হলুদ চাদরে মুড়ে আছে টিলা। শুকনো রুখু বাতাসে মাঝেমধ্যে মাতালের মতো ওলটপালট খাচ্ছে ঝরাপাতা।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

এখানেই জিপ নিয়ে অপেক্ষা করছেন স্থানীয় সরপঞ্চ এবং প্রাক্তন পুলিশকর্মী রঞ্জিত সিংহ ভিলালা। বনবাসীদের এক পোড়খাওয়া নেতা ও আন্দোলনকারীও বটে। “এখান থেকে কাছেপিঠেই বেশ কয়েকটা আদিবাসী গ্রাম। সবলগড়, বিরসা, মেহেন্দিখেড়া, কাট্টুকিয়া..। চলুন, আগে আপনাকে মেহেন্দিখেড়াতেই নিয়ে যাই। ওখানে এক বার পুলিশ গুলি চালিয়ে বনবাসী উচ্ছেদের চেষ্টা করেছিল। মারা যায় পাঁচ জন। তখনই তো চাকরি ছেড়ে দিই। চোখের সামনে সব ঘটে, নিজে আদিবাসী হিসেবে মেনে নিতে পারিনি।” তার পরেই আদিবাসী মুক্তি মোর্চা গড়েছেন ভিলালা।

সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের ফলে ১০ লক্ষের বেশি বনবাসী এবং অন্যান্য আদিবাসী পরিবারকে উচ্ছেদ করা হলে এখানকার গ্রামগুলিতে ফের বন্দুকের সঙ্গে পাথরের অসম লড়াই হবে কি না বা তার জেরে সামনে ছবির মতো ফ্রেমগুলি মরা কুটিরের সারিতে পরিণত হবে কি না, তা এখনও স্পষ্ট নয়। “আমরা একটু সাবধানে আছি এখন। যে-কোনও সময় পুলিশ তুলে নিতে পারে। সামনে ভোট। মোদীর সরকারকে এখানে আর কেউ বিশ্বাস করে না এখানে,” বলছেন ভিলালা। তবে অদূর ভবিষ্যতে শান্তি বজায় রেখেই বড় মাপের আন্দোলন করার কথা ভাবা হচ্ছে বলে জানান তিনি। “মধ্যপ্রদেশের গোটা বারো আদিবাসী সংগঠন নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখছে। প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতির কাছেও যাব। এত বছরের ভিটেমাটি ছেড়ে এরা যাবেটা কোথায়,” প্রশ্ন ভিলালার।
এই প্রশ্নচিহ্নটিকে সামনে রেখেই পৌঁছলাম মেহেন্দিখারায়। ২০০১-এর ২ এপ্রিল এই গ্রামে পুলিশের গুলিতে নিহত পাঁচ আদিবাসীর মূর্তির টান্টিয়া মামার পাশেই জায়গা পেয়েছে। প্রতি বছর ওই দিনে নিকটবর্তী গ্রামগুলিতে পুজো করা হয় তাঁদের।

ইনদওর জেলা সংলগ্ন এলাকার মুখচলতি মাণ্ডবী ভাষা এই অঞ্চলে এসে দেখি বদলে গিয়েছে। জানা গেল, এখানকার কথ্য ভাষার নাম নিমড়ি। ভিলালা এবং শহর থেকে সঙ্গ নেওয়া আর এক আন্দোলনকারী লীলা ধর চৌধুরির তর্জমায় প্রায় ইন্দির ঠাকরুনের বয়সি তান্নু বাইয়ের দালানের খাটিয়ায় বসে কথোপকথন শুরু হল। মাঝখানে দু’বার এল কেন্দুপাতায় মোড়া তামাক (স্থানীয় বিড়ি) আর মহুয়া। রুগ্‌ণ চেহারার কিছু ছাগল, গরু আর বনমোরগ চরে বেড়াচ্ছে ইতিউতি। “গত বছর এত শুখা গিয়েছে, লোহার নদীতে তো পুরো চড়া। পানি নাই, আনাজ হয়নি ভাল। জানোয়ারদেরও ঠিকমতো খাওয়াতে পরিনি। তবু এ আমার চোদ্দো পুরুষের ভিটে। এখানেই মরি, বাঁচি। তুলে দিলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব,” বলছেন সেই পুলিশ অ্যাকশনের আর এক সাক্ষী তান্নু।

তান্নুবুড়ির কথা সত্যি। এটাই তো এঁদের দেশ। একশো, দেড়শো, দু’‌শো বছরের। ছেড়ে কোন বিদেশে যাবেন! ভিলালা পরিসংখ্যান দিলেন, “স্থানীয় এসডিও অফিসে পাট্টার জন্য পড়ে আছে তেরো হাজার আবেদনপত্র। বছরের পর বছর। খালি বলে ছানবিন করে রিপোর্ট বানিয়ে তার পরে দেবে! গোটা জেলায় না-হোক ২৭টি গ্রামে চল্লিশ হাজার লোকের বসতি। অথচ যাঁদের কাছে পাট্টা রয়েছে, তাঁদের সংখ্যা সাত-আটশোর বেশি হবে না। তা-ও সে পুরনো কংগ্রেসি জমানায় পাওয়া।” এই চল্লিশ হাজারের মধ্যেই রয়েছেন বারেলে, ভিলালে, বোথা, গোন্ড-সহ বিভিন্ন আদিবাসী সমাজ।

সামনেই উবু হয়ে বসা বৃদ্ধ দীপ বুদ্যা জানালেন, ডেপুটি ফরেস্ট রেঞ্জার নাকি গ্রামে গ্রামে গিয়ে বলছেন, ‘যা খেতি করছ, এই বেলা গোলায় তুলে নাও। ভোটের পরে তোমাদের ভাগানো হবে এখান থেকে!’

যদিও সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পরে এখনও এই গ্রামে এসে বিষয়টির ব্যাখ্যা করেনি কোনও রাজনৈতিক দল। বরং ভোটের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো মধ্যপ্রদেশের মানচিত্রে এই গ্রামগুলি যেন একটু ব্রাত্যই। তবে তাদের এককাট্টা বিশ্বাস, কংগ্রেস সরকার গড়লে বনবাসীদের হটানোর এই নির্দেশে কোনও না কোনও ভাবে আটকানো যাবে। এই বিশ্বাসের উৎস, ২০০৬ সালে মনমোহন সরকারের আনা অরণ্যের অধিকার আইন। মোদী সরকার এসে সেই আইনকে নিজেদের সুবিধার জন্য ফোঁপরা করে দিয়েছে বলেই মনে করছেন গ্রাম-মাতব্বরেরা।

ফেরার রাস্তায় ছাড়তে উদয়নগর বাজার পর্যন্ত এলেন ভিলালা আর লীলা। বললেন, “এখানে প্রতি বছর হোলির সময় আদিবাসীদের মেলা বসে। ভোগারিয়া হাট বলা হয়। নাচ হয় জোছনা রাতে। জানি না, সামনের বছর কী হবে!”

গোটা দেশের আদিবাসী ও অন্যান্য বনবাসী পরিবারের গভীর অনিশ্চয়তার সুরই কি ওঁদের কণ্ঠে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন