পসকো রুখেও ফিরে আসেনি পানের বরজ 

দিন বরাবর এমন ছিল না ভীমসেনের। এই গোবিন্দপুর জঙ্গলেই ছিল পানের বরজ। নিজে তো বটেই, আশপাশের আরও জনা আট-দশ লোক খাটতেন সেই বরজে।

Advertisement

সৈকত বসু

ঢিঙ্কিয়া শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:৫৩
Share:

মেয়ে জয়ন্তীর সঙ্গে সুরেশ রাউত। নিজস্ব চিত্র

গোবিন্দপুরের জঙ্গলে বসে এক মনে ঝাউ গাছের ডাল চাঁচছিলেন ভীমসেন দাস। দিনভর জঙ্গলে ঘুরে কাঠকুটো কুড়িয়ে আনেন। কুড়ুল দিয়ে মাপমতো কাটেন। জঙ্গলেই দাঁড়িপাল্লা খাটিয়ে বিক্রির ব্যবস্থা আছে। দু’চার টাকা যা হয়, তাই দিয়ে দিনান্তে ঘরে চুলো জ্বলে।

Advertisement

দিন বরাবর এমন ছিল না ভীমসেনের। এই গোবিন্দপুর জঙ্গলেই ছিল পানের বরজ। নিজে তো বটেই, আশপাশের আরও জনা আট-দশ লোক খাটতেন সেই বরজে। মাস গেলে অন্তত ২০ হাজার টাকা রোজগার বাঁধা। ২০১৩-র জুন মাসে সেই বরজ ভেঙে দিয়ে গিয়েছে ওড়িশা পুলিশ। দক্ষিণ কোরিয়ার ইস্পাত প্রস্তুতকারক সংস্থা পসকো-র জন্য জমি জোগাড়ের তাগিদে। আর সেই থেকেই আতান্তরে ভীমসেন, সুরেশ রাউত, ভ্রমর দাসেরা।

পারদ্বীপের বঙ্গোপসাগর লাগোয়া এলাকায় পসকো-কে জমি দেওয়ার কথা ২০০৫ সালে ঘোষণা করেছিল নবীন পট্টনায়কের সরকার। ঢিঙ্কিয়া, নুয়াগা আর গদাকুজঙ্গ গ্রাম পঞ্চায়েতের ৪০০৪ একর জমি। যার মধ্যে ৩০০০ একর বনভূমি। বিদ্রোহের আগুন জ্বলল। পসকো-বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠল ঢিঙ্কিয়া। “টানা আট বছর আমরা গ্রামে ঢুকতে দিইনি ওদের,” বলছিলেন প্রকাশ জেনা। পসকো প্রতিরোধ সংগ্রাম কমিটির নেতা।

Advertisement

কিন্তু আন্দোলনে ঢিল পড়েছিল কোথাও। তারই ফাঁক ধরে গ্রামে পুলিশ ক্যাম্প বসল। তার থেকে পাঁচশো মিটার দূরে বোমা ফেটে মারা গেলেন তিন জন প্রতিরোধ কর্মী। পুলিশ বলল, ‘‘ওরা বোমা বানাচ্ছিল।’’ আর গ্রামবাসীদের বিহ্বলতার সুযোগ নিয়ে পর দিন ভোর থেকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দিল একের পর এক পানের বরজ। কেটে ফেলা হল হাজার হাজার গাছ।

“গোটা এলাকার নিজস্ব অর্থনীতিটাই ধ্বংস করে দিল প্রশাসন,” বললেন সংগ্রাম কমিটির মুখপাত্র প্রশান্ত পাইকরায়। পান-ধান-মীন এই নিয়েই দিন গুজরান ঢিঙ্কিয়ার। সমুদ্র লাগোয়া বালি জমিতে তৈরি পান বিখ্যাত বারাণসীতে। বনভূমির বাইরে আদিগন্ত সবুজ মাঠ। বছরে দু’বার ধান বাঁধা। জাল ফেললেই মাছ। আর রয়েছে কাজু। অযত্নের গাছ আপনি বাড়ে। তুলে নিয়ে ব্যাপারিদের দিলে কেজি প্রতি অন্তত ১০০ টাকা।

প্রশান্তের মতে, “ইস্পাত কারখানার পিছনে না দৌড়ে পান-কাজু উৎপাদনে সরকার সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলে এখানকার মানুষগুলোর উপকার হত। হ্যাঁ, তাতে অবশ্য রাজনীতির কারবারিদের কোনও লাভ হত না।” কিন্তু কারখানা হলে এলাকার উন্নতি হত, স্থানীয় মানুষ কাজ পেতেন। প্রশাসন তো তেমনই আশ্বাস দিয়েছিল। “কাজ বলতে তো দিনমজুরি। তার থেকে বেশি কাজ করার বিদ্যা কোথায় এদের পেটে! চাষ করলে তার তিন গুণ রোজগার হয়,” দাবি করছেন প্রশান্ত।

তাই জমি আঁকড়ে রইলেন ওঁরা। সরকারের অবশ্য বক্তব্য, এ সব খাস জমি। গ্রামবাসীরা দখলদার। ভীমসেন আবার দাবি করছেন, তাঁর বাপ-ঠাকুরদারা দেড়শো বছর ধরে জঙ্গলে আবাদ করছেন। সেই নথিপত্রও দাখিল করেছেন তাঁরা। কেউ কান পাতেনি। সুতরাং তাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছেন।

এমনিতে লজ্জায় মুখ তোলেন না। কিন্তু সে দিনের কথা বলতে

গেলে এখনও চোখের কোণে বিদ্যুৎ ঝলকায় অবন্তী দাসের। “বালিতুঠে তালদণ্ডা নদীর উপরে ব্রিজের এক দিকে ওরা, অন্য দিকে আমরা। বললাম, জমি গেলে আমাদের আর থাকবে কী! তার চেয়ে গুলি করে

মার। আমাদের লাশের উপরে কোম্পানি হোক।”

নিমেষে উস্কে ওঠে নন্দীগ্রামের স্মৃতি। নদীর নামেও কী আশ্চর্য মিল সেই তালপাটি খালের সঙ্গে!

পসকো পাততাড়ি গুটিয়ে বিদায় নিয়েছে ২০১৩ সালেই। তার পরেও হাল ছাড়েনি ওড়িশা সরকার। ঘোষণা করেছে, সব জমি ল্যান্ড ব্যাঙ্কে নিয়ে নেওয়া হল। এখন জিন্দলদের দিয়ে ইস্পাত কারখানা তৈরির তোড়জোড় চলছে। ১৮ কিলোমিটার পাঁচিল তুলে জমি ঘেরার কাজ শুরু হয়েছিল। পরিবেশ আদালতে মামলার জেরে থমকে গিয়েছে।

থমকে ঢিঙ্কিয়াও। আন্দোলনের উত্তেজনা মিইয়ে গিয়েছে। মাথায় এখন সংসার টানার দুশ্চিন্তা। পুলিশের আনাগোনা এখন আর বিশেষ নেই। তবু জঙ্গলের জমিতে নতুন করে পানের বরজ করার ভরসা করেননি প্রায় কেউই। ভ্রমর বললেন, “হাতে টাকা কোথায়? দশ শতক জমিতে বরজ করতেও লাখ টাকার ধাক্কা। এ ক’বছর বসে খেয়ে আর মামলা সামলে সকলেরই হাঁড়ির হাল।”

জমি জবরদখল থেকে শুরু করে পুলিশের সঙ্গে মারপিট— শুধু গোবিন্দপুরেই অন্তত ১৩০০ লোকের বিরুদ্ধে মামলা ঝুলছে। প্রকাশ জেনার নামেই ৩১টা মামলা। জেল খাটা হয়ে গিয়েছে ৮ মাস ১৪ দিন। ধার-কর্জ করে ফের পান চাষ শুরু করলে পুলিশ যদি নতুন মামলা দেয়, সেই ভয়ও রয়েছে। তাই রুজির টানে কেউ পারাদ্বীপের কারখানায় মজুর খাটছেন। কেউ কেউ চলে গিয়েছেন ভিন রাজ্যে।

সুরেশ রাউত পড়ে আছেন জঙ্গলেই। মেয়ে জয়ন্তী দুপুরবেলা টিফিন কেরিয়ার করে খাবার নিয়ে আসে। এ বছর মাধ্যমিক দিয়েছে। তার পর কী করবে? “আমি তো পড়তে চাই। কিন্তু বাবা বলছে পড়াবে না।”

“পারব কী করে।” ঝাঁঝিয়ে ওঠেন সুরেশ। বড় ছেলে ভুবনেশ্বরে আইটিআই-তে পড়ে। তার খরচ টানতেই নাজেহাল। আর এ পোড়া দেশে মেয়েরা তো চিরকালই হেলাফেলার ধন। সুরেশের সঙ্গীরা অবশ্য বোঝান, ‘‘কষ্ট করে হলেও মেয়েটাকে পড়াও, মানুষ কর। ওরও তো ভবিষ্যত আছে।’’

ঘাড় নিচু করে শোনেন সুরেশ। তার পর অস্ফুটে বলেন, “অমন পাঁচটা মেয়েকে পড়াতে পারতাম। শুধু পানের বরজটা যদি থাকত।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন