বারাণসীতে প্রচারে নরেন্দ্র মোদী। ছবি: রয়টার্স।
‘‘জানেনই তো বাঙালিদের জন্মভূমির প্রতি কৃতজ্ঞতা একটু বেশিই। আগে দেশ, তার পর অন্য কিছু। দেশের সঙ্গে যারা বেইমানি করে তাদের আমরা পছন্দ করি না।’’
‘দেশ’ তথা নরেন্দ্র মোদীর জন্য সকাল থেকে গলা ফাটাচ্ছেন বিশ্বনাথ সরকার। চিন্তামণি মুখার্জি অ্যাংলো বেঙ্গলি প্রাইমারি স্কুলের আলপনা দেওয়া প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে। বাঙালিটোলার এই বুথটিতে বিশ্বনাথবাবু একটি পরিচিত নাম। এখানকার তিনটি বড় বঙ্গীয় সাংস্কৃতিক সমাজের হর্তাকর্তাও বটে। বারাণসীতে জন্ম ও পড়াশুনোর পর বিমা সংস্থায় জনসংযোগ আধিকারিকের কাজে যোগ দেন।
প্রবাসের বঙ্গসমাজ যে মোদীর প্রতি অনুগত, বোঝাতে ভোট চত্বরেই অনেকের সঙ্গেই আলাপ করতে শুরু করলেন তিনি। কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল, কেউ বা অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা। পাল্টা প্রশ্নই ধেয়ে এল বেশি। ‘‘কেন নরেন্দ্র মোদীর মত মহান জাতীয়তাবাদী নেতার সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল হিংসার পথে চলছে?’’ ‘‘কেন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা হল?’’ ‘‘যদি হলই বা, তা হলে কেন অমিত শাহের উপর দোষ চাপানো হল?’’
হিসেব মতো বারাণসীর প্রায় পৌনে দু’লাখ বাঙালির মধ্যে ষাট হাজারের বসবাস এই বাঙালিটোলা চত্বর এবং তার আশেপাশে। তাঁদের কৌতূহল এবং রোষ যথাসাধ্য এড়িয়ে মোদী-মুগ্ধতার কারণ জানতে চাওয়ায় ফাটা রেকর্ডের মতো যে স্থানীয় যুক্তিগুলি গত দু দিন ধরে শুনে আসছি, সেগুলিরই পুনরাবৃত্তি শোনা গেল। অর্থাৎ পরিকাঠামোর উন্নতি, বিমানবন্দর থেকে শহরে আসার রাস্তায় ৩ কিলোমটারের উড়ালপুল, চওড়া বড় রাস্তাগুলির সংস্কার, বিদ্যুদয়ন, স্থানীয় গুন্ডামির অবসান ইত্যাদি।
কিন্তু সার্বিক এবং বৃহত্তর কারণ, এ রকম নিখাদ হিন্দু মন আর কবে কোন প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দেখা গিয়েছে? ‘‘ওনার এতটাই আত্মবিশ্বাস যে, ভোটের দিন বারণসীর কোনও বুথে এসে দাঁড়ানোর প্রয়োজনই পড়ল না! হর হর মহাদেব বলে কাশী বিশ্বনাথের এই পূণ্যভূমে প্রচার করে গিয়েছিলেন প্রথমেই। আর ভোটের সময় শিবের গুহায় ধ্যান করছেন’’, ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে জানাচ্ছেন পক্ককেশ ডাক্তার সত্যরঞ্জন সান্যাল। হিন্দুত্বের সনাতন এই রসে আপ্লুত ভোট দিতে আসা আর এক বাঙালি মীনা সমাদ্দার জানালেন, ‘‘আমাদের পুজো, অর্চনা, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠান সবেতেই বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের সহযোগিতা পাই। এটা যাদব সরকারের সময় কোথায় ছিল?’’
অথচ দেড়শো বছরের পুরনো পিরিয়ড ছবিতে মানানসই হতে পারে এমন চেহারার স্কুলটিতে ঢোকার আগেই, পাঁচশো মিটার দূরে সম্পূর্ণ বিপরীত কথা শুনে এসেছি। যদিও তা সংখ্যালঘিষ্ঠের স্বর। বাঙালিটোলা জায়গাটা পান্ডু হাভেলিতে, যার সীমানাতেই মদনপুরা। বারাণসীর সবচেয়ে বড় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা। যাঁরা বেনারসি শাড়ির কারিগর।
আজ সকাল থেকে শহর এতটাই শুনশান যে, মৃদু গতির ষাঁড় আর দ্রুত গতির পতাকা ওড়ানো বাইক ছাড়া রাস্তায় চলমান কিছু নেই। একগ্লাস লস্যি খেতে গেলেও কয়েক ক্রোশ হাঁটার জোগাড়। দোকানপাট সব বন্ধ। বাঙালিটোলায় ঢোকার জন্য মদনপুরার সীমানা ছাড়ানোর মুখে দেখি, রাস্তার ধারে চৌকি পেতে চলছে খোশগল্প। এ রকমই একটি চৌকির কাছে গিয়ের পরিচয় দিতেই সমস্বরে কথা বলতে শুরু করলেন জামাল নাসির, মহম্মদ আসলাম, মহম্মদ আকবর হুসেনরা। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এঁরা অনেক দিন গলা তুলে কথা বলতে পারেননি। এঁদের কথা শোনারই কেউ নেই এই কাশী বিশ্বনাথের ধামে। এঁরা সকলেই প্রায় শাড়ি শিল্পী। ‘‘মোদী প্রচারে এসে বলছেন, এখানকার গলিগলিতে নাকি বিকাশ দৌড়চ্ছে। কই আমরা তো কুত্তা ছাড়া কিছু দৌড়তে দেখি না!’’ ‘‘২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসে আমাদের মতো বুনকারদের জন্য অনেক আশার কথাবলেছিলেন। এখন মিঠাই-বিস্কুট বেচে ডাল-রুটি খেতে হচ্ছে।’’ তাঁদের সমবেত বক্তব্য, জিএসটি আর নোটবন্দির পর ব্যবসায় হাঁড়ির হাল। রফতানি মুখ থুবড়ে পড়েছে। আগে এই মদনপুরা ছিল বেনারসির গড়। প্রায় এক হাজার বেনারসি কারখানা ছিল এখানে। এখন তা নেমে এসেছে পঞ্চাশে। রমজানের মতো কোনও তেওহার উদযাপন করতেও চিন্তা করতে হচ্ছে। ধর্মীয় উস্কানির অভিযোগও তুলল চৌকির আড্ডা।
বাঙালিটোলা অবশ্য এসব উড়িয়ে দিচ্ছে। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা ব্রততী চক্রবর্তী কথাগুলোকে আমল না দিয়েই বললেন, ‘‘কই মোদীর জনসভায় তো শাল ছুড়তে শোনা গিয়েছে মুসলমানদের। দিব্যি খুশি রয়েছেন ওঁরা। মোদী এখানে যত বারই এসেছেন, এমন আপন করে কথা বলেছেন যে খুশি না হয়ে উপায় কই!’’