জীবন সার্থক, ছেলের চাকরি চান ‘ডোম রাজা’

একে দলিত। তার উপরে ডোম সম্প্রদায়ের। বংশ পরম্পরায় পরিবারের জীবিকা— মৃতদেহের সৎকার। এ হেন জগদীশকে প্রস্তাবক করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন মোদী।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:০২
Share:

বারাণসীর ‘ডোম রাজা’ জগদীশ চৌধরি। —নিজস্ব চিত্র।

মণিকর্ণিকা ঘাটের কখনও না নেভা চিতার সারিকে পিছনে ফেলে ত্রিপুরা-ভৈরবী ঘাটে নৌকা যেখানে ভিড়ল, তার সামনে থেকেই উঠে গিয়েছে তাঁর বাড়ির খাড়া সিঁড়ি। প্রথমে সেই সিঁড়ি আর তারপরে বাড়ির মধ্যে ঘুটঘুটে অন্ধকার অংশ পেরিয়ে ঘরে ঢুকতেই খাটের উপরে পা মুড়ে বসে তিনি। কপালে ঘাম। হাতে আজ আর থামতে না জানা মোবাইল। গরমে কাহিল হয়ে ধুতি হাঁটুর উপরে। গায়ে গামছা জাতীয় কিছু। মুখভর্তি পানমশলার ঠেলায় কথা বোঝা দায় ‘ডোম রাজা’ জগদীশ চৌধুরির। বারাণসী কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রার্থী পদের প্রস্তাবক হিসেবে আজ রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছেন তিনি।

Advertisement

একে দলিত। তার উপরে ডোম সম্প্রদায়ের। বংশ পরম্পরায় পরিবারের জীবিকা— মৃতদেহের সৎকার। এ হেন জগদীশকে প্রস্তাবক করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন মোদী। হিন্দুত্ব আর জাতপাতের সমীকরণের কথা মাথায় রেখে বাকি তিন প্রস্তাবকের নামও বাছা হয়েছে সযত্নে। বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিলা কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষা ৮১ বছরের অন্নপূর্ণা শুক্ল (ব্রাহ্মণ)। যিনি চিকিৎসক শুধু নন, বারাণসীতে তাঁর পরিচিতি হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠাতা মদনমোহন মালবীয়ের ‘মানস কন্যা’ হিসেবেও। ছিলেন প্রবীণ বিজেপি কর্মী সুভাষচন্দ্র গুপ্ত (বৈশ্য) ও জাতীয় পুরস্কার জয়ী কৃষিবিজ্ঞানী রামশঙ্কর পটেল (ওবিসি)।

মনোনয়নপত্র পেশের আগে ৮১ বছরের অন্নপূর্ণাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছেন মোদী। তবে দিনভর সব থেকে বেশি চর্চা হয়েছে সম্ভবত জগদীশকে ঘিরে। এমনিতে তাঁর বাড়ি এক ডাকে চেনে বারাণসী। গঙ্গায় নৌকা করে যাওয়ার সময়ে আঙুল তুলে মাঝি বলেন, ‘‘ওই যে কালু ডোমের বাড়ি।’’ যার দরজার দু’দিকে দু’টি বাঘের মূর্তি থাকায় অনেকে ঠিকানা হিসেবে শেরাওয়ালি ঘাট বলেন।

Advertisement

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কথিত আছে, ঋষি বিশ্বামিত্রের শাপে সর্বস্ব খুইয়ে রাজা হরিশচন্দ্র যখন শেষে বারাণসী আসেন, তখন জগদীশের পূর্বপুরুষ কালু ডোমের অধীনেই দেহ সৎকারের কাজ করতেন তিনি। সেই থেকে বারাণসীর সমস্ত ঘাটে যত মৃতদেহ পোড়ানো হয়, তাতে হাত ‘ডোম রাজা’র। এই কাহিনি জানিয়ে জগদীশ নিজেই বলেন, ‘‘৩৭-৩৮ বছর এই কাজ করছি। এখন রাজা-মহারাজার বংশধর, বড় সরকারি অফিসারের মতো কেউ না হলে, নিজে হাতে এ কাজ করি না। তা করেন আমাদেরই জাতের লোকেরা। অন্নের সংস্থান হয় ওই করেই।’’

স্ত্রী, এক পুত্র, দুই কন্যা, ভাই, তাঁর পরিবার— এমন অনেককে নিয়ে তাঁদের একান্নবর্তী পরিবার। যে ঘরে তিনি বসে, তার পাশের বারান্দাতেই বাঁধা রয়েছে গরু। বললেন, ‘‘এক পরিচিতই প্রথম বলেন মোদীর নামের প্রস্তাবক হওয়ার কথা। এক কথায় রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। যিনি দেশের জন্য এত কাজ করছেন, তাঁর জন্য এটুকু করতে পারা তো সৌভাগ্যের।’’ আর ‘তাঁকে’ এত কাছ থেকে এ ভাবে দেখে তিনি আত্মহারা। শুধু বললেন, ‘‘একাধিক বার আমার হাত ধরে ধন্যবাদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’’ সেল্‌ফি নিতে ইচ্ছে যে হয়নি, এমন নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তো, তাই মুখ খোলেননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী চলে যেতেই তাঁর সঙ্গে সেল্‌ফি নিয়েছেন অনেকে। কেউ সাক্ষাৎকার চাইছেন, তো কেউ চাইছেন একটু কথা বলতে। জগদীশের দাবি, ‘‘এমনিতে আমাদের সম্প্রদায় সমাজে উপেক্ষিত। এই প্রথম তাকে স্বীকৃতি দিলেন কোনও রাজনৈতিক নেতা। তা-ও আবার খোদ প্রধানমন্ত্রী।’’ এর পরে অন্তত উপেক্ষা, বৈষম্য কিছুটা কমবে বলে আশাবাদী তাঁরা।

যদিও দলিত জগদীশকে প্রস্তাবক হিসেবে বাছাইয়ের পিছনে রাজনীতির চাল রয়েছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল। গত পাঁচ বছরে বার বার বিজেপির বিরুদ্ধে দলিত নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছে। এর মাধ্যমে মোদী দলিতদরদী ভাবমূর্তি চাঙ্গা করার চেষ্টা করলেন বলে ধারণা অনেকের। এর আগে কুম্ভে স্নান সেরেও সাফাই কর্মীদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন তিনি। জাতপাতের এই সমীকরণকে মাথায় রেখে সম্ভবত তাঁর বাকি তিন প্রস্তাবক— ব্রাহ্মণ, ওবিসি এবং বৈশ্য। অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ২০১৪ সালের মনোনয়ন পেশের সময়েও এই সমীকরণ মাথায় রেখেছিলেন মোদী।

আজকের দিনে অবশ্য ওই সব কথা মাথায় ঢুকছে না জগদীশের। বললেন, ‘‘আমার জীবন সার্থক। শুধু ছেলেটার সরকারি চাকরি হলে নিশ্চিন্তি।’’ ভোটের পরে নেতারা যে অনেককে এবং অনেক কিছু ভুলে যান, তা তিনি আলবাৎ জানেন। তবে মোদী তেমন নন। অন্তত সেই আশায় বুক বাঁধছেন তিনি।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement