তবু ছায়াময় ‘মৌসম বিজ্ঞানী’

১৯৭৭ সালে শুরু। তার পর থেকে লাগাতার হাজিপুরের সাংসদ রামবিলাস। মাঝে হেরেছেন ২০০৯ সালে। ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত রাজ্যসভায় ছিলেন। ৪২ বছর পর ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন।

Advertisement

দেবব্রত ঠাকুর

হাজিপুর শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৯ ০৪:৫১
Share:

রামবিলাস পাসোয়ান

লালুপ্রসাদ তাঁকে ভারতীয় রাজনীতির ‘মৌসম বিজ্ঞানী’ আখ্যা দিয়েছিলেন। রাজনীতি নির্বিশেষে সকলেই এই মূল্যায়নের সঙ্গে একমত। যাঁর সম্পর্কে লালুর এই মন্তব্য, তিনি উষ্মা প্রকাশ করেই বলেছিলেন, টিকে থাকতে গেলে প্রত্যেক রাজনীতিকেরই এই গুণটি থাকা আবশ্যিক। ভারতীয় রাজনীতির এই ‘মৌসম বিজ্ঞানী’-র নাম রামবিলাস পাসোয়ান।

Advertisement

১৯৭৭ সালে শুরু। তার পর থেকে লাগাতার হাজিপুরের সাংসদ রামবিলাস। মাঝে হেরেছেন ২০০৯ সালে। ২০১০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত রাজ্যসভায় ছিলেন। ৪২ বছর পর ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে তিনি সরে দাঁড়িয়েছেন। তবে রাজনীতিতে আছেন। প্রবীণ রাজনীতিক এ বার ফের রাজ্যসভাতেই যেতে চান।

কিন্তু হাজিপুর লোকসভার ভোটের বাজারে প্রায় সর্বত্রই তিনি রয়েছেন ছায়াময়ের মতো। সত্যি বলতে কী, এখনও হাজিপুরের বহু মানুষ জানেন না যে রামবিলাস আর প্রার্থী নন, প্রার্থী তাঁর ভাই পশুপতি পারস। তিনি ভোটে জিতুন বা হারুন, তার সব দায়ই রামবিলাসের। ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি মন্ত্রী।

Advertisement

ঠিক সময়ে ঠিক জায়গা থাকাটা তাঁর ধাতে। বিশ্বনাথপ্রতাপ থেকে শুরু, মাঝে পিভি নরসিংহ রাওকে বাদ দিলে তার পরের সব কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভারই তিনি সদস্য ছিলেন। ছিলেন মনমোহন সিংহের প্রথম ইউপিএ সরকারেও।

উল্লেখ করা যেতে পারে, এই রামবিলাস রেলমন্ত্রী থাকার সময়েই ইস্টার্ন রেল ভেঙে পূর্ব-মধ্য রেলের জন্ম হয়। এবং পূর্ব-মধ্য রেলের সদর দফতর তৈরি হয় হাজিপুরেই। সেই প্রসঙ্গ উঠতেই ঠাকুর ইন্দুভূষণ সিংহ মনে করালেন, ‘‘ইয়াদ হ্যায় মমতা দিদি কিতনা চিল্লায়ি!’’ রামবিলাসের সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন মমতা। কিন্তু নিজের লোকসভা ক্ষেত্রের জন্য যা করার তিনি তো করে দিয়েছেন। রেলের এই সদর দফতর হাজিপুরের গুরুত্ব যেমন বাড়িয়েছে, তেমনই বাড়িয়ে দিয়েছে হাজিপুরবাসীদের ছাতির মাপও। আজও তাঁরা সমান গর্বিত। হাজিপুর বাজারের ব্যবসায়ী প্রবীণ কুমারের কথায়, রেলের এই দফতরের ফলে হাজিপুরের অর্থনৈতিক কাজকর্মও বাড়িয়ে দিয়েছে।

রামবিলাসের দল লোক জনশক্তি পার্টির (এলজেপি—বিহারের মানুষ বলেন ‘লোজপা’) জেলা সভাপতি রাজপুত। নাম জিজ্ঞেস করতেই বলিউডি কায়দায় বললেন ঠাকুর ইন্দুভূষণ সিংহ। দলিত নেতার দলে রাজপুত কার্যকর্তা! বিস্ময় প্রকাশ করতেই বললেন, ‘‘রামবিলাস শুধুই পাসোয়ান নেতা নন। আর মায়াবতীর দলেও তো ব্রাহ্মণ নেতা রয়েছেন।’’ একটি বাণিজ্যিক কমপ্লেক্সের বেসমেন্টে লোজপার অফিস। ফ্লেক্স দিয়ে তৈরি বিশাল গেট। গেট যত বড়, অফিস ততটা নয়। গেট পার হয়েও খুঁজে না পেয়ে এক দোকানিকে জিজ্ঞাসা করতেই ডান দিক দেখিয়ে বললেন, ‘‘এই তো কাছেই।’’ তবুও খুঁজে না পেয়ে আর এক দোকানদারকে প্রশ্ন করতেই তিনি বাঁ দিক দেখিয়ে বললেন, ‘‘পাশেই।’’ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন দয়া করে দেখিয়ে দিলেন বেসমেন্টে, সিঁড়ির নীচে।

একটু হতাশাই কাজ করল মনে। তবে জিলা অধ্যক্ষ ‘ঠাকুর সাব’ যখন আপ্যায়ন করলেন তখন আশ্বস্ত হলাম। ভোটের এই ছন্নছাড়া ভাব কেন, প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন, ‘‘আমাদের ভোট এক মাস দেরি। মনোনয়ন পেশ করে তবেই তো প্রার্থী প্রচারে আসবেন। তা ছাড়া প্রার্থী পশুপতি নাথ তো লোজপার রাজ্য সভাপতি। এখনও রাজ্যের মন্ত্রী। তাঁর তো

অনেক দায়িত্ব।’’ আর আপনারা? ঠাকুর সাবের চটজলদি জবাব, ‘‘দেখিয়ে না, স্ট্র্যাটেজি বনা রহে।’’ তা বটে, স্ট্র্যাটেজি-ই তো আসল!

এখানে পাসোয়ান ভাইদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আরজেডির শিবচন্দ্র রাম। হাজিপুর লোকসভারই অন্তর্গত রাজাপাকড়ের বিধায়ক। মহাজোট সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন। মনোনয়ন জমার অপেক্ষায় না থেকে নেমে পড়েছেন প্রচারে। এপ্রিলের শুরুতেই চাঁদি ফাটা গরমে এলাকায় এলাকায় ঘুরছেন তিনি। আরজেডি অফিসে বসা এক কর্মী বললেন, ‘‘মন্ত্রীজি (এই একটি বিষয়, একবার মন্ত্রী তো কী, অনুগামীদের কাছে তিনি সারা জীবনই ‘মন্ত্রীজি’) তো সুবহি নিকাল গয়া।’’ এর পরে মন্ত্রীজি কেন জিতবেন, তা স্পষ্ট করলেন ঘরে বসা আরও জনাকয়েক কর্মী। পাসোয়ান ভাইদের মতো শিবচন্দ্র রাম তো এলাকা ছেড়ে যাবেন না। এই এলাকার মানুষ। মানুষের পাশেই থাকবেন। এটাই আরজেডি প্রার্থীর সব থেকে বড় ‘ইউএসপি’। কিন্তু রামবিলাস? সমস্বরে জবাব, ‘‘আরে দাদা ছোড়িয়ে, ইসবার চান্স কম থা, ইস লিয়ে হটকে ভাইকো ডাল দিয়া।’’

চায়ের কাপে রাজা-উজির মারিয়েদের পিছনে ফেলে গাড়ি

ছুটল। লক্ষ্য বলবা-কোয়ারি। রামবিলাসের দত্তক গ্রাম। খুচখাচ গাড্ডা থাকলেও রাস্তাই। গ্রামে ঢোকার মুখে একটি মন্দির। চাতালও আছে। সেখানেই বসে রাজকুমার জানালেন, গ্রামে বিদ্যুৎ আছে, মোবাইল সিগন্যালও পাওয়া যায়। পানীয় জল, রাস্তা সবই আছে। রামবিলাসজি তো তা হলে ভালই কাজ করেছেন! সমস্বরে প্রতিবাদ, না, না। এ সব তো নীতীশজি করেছেন। জিতবে কে? এক যুবকের চটপট জবাব, ‘‘দিল্লি মে মোদীজি আয়েগা।’’ এক বৃদ্ধ ধমকে উঠল, ‘‘লালুজি মর গৈল ক্যা!’’

তর্কাতর্কি থেকে যেটুকু উদ্ধার করা গেল— বৈশালী জেলার যাদব-প্রধান এই গ্রামটিতে লালুজির প্রভাব রয়েছে। কিন্তু তরুণ যাদবেরা আর ততটা অনুগত নন। তাঁদের পাল্টা যুক্তিতে রয়েছে, নীতীশের উন্নয়ন আর নরেন্দ্র মোদীর সার্জিকাল স্ট্রাইক।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন