বেচারাজির দলিত মহল্লায় চামুন্ডা মন্দির। নিজস্ব চিত্র
গুজরাত মডেল।
কতদিন শোনা হয়নি!
বেচারা এই শব্দ দু’টিও এখন বিলুপ্তির পথে। নিভৃতে ঘর করছে ‘অচ্ছে দিন’-এর সঙ্গে।
খোদ নরেন্দ্র মোদীই আর মুখে আনেন না শব্দগুলো। যে ‘মডেল’ তিনি গোটা দেশে প্রয়োগের কথা বলেছিলেন। তবে মডেলটি দিব্য আছে গুজরাতে। বিরোধীদের মতে যার মূল মন্ত্রটি হল, ‘আড়ম্বরের বাদ্যিতে যেন শোনা না-যায় অসন্তোষের সুর।’
উনায় দলিত নিগ্রহের ঘটনা তো বেশ পুরনো। বেচারাজিতে না-এলে জানতেও পারতাম না, কয়েক মাস আগেই এখানে আর এক দলিত কিশোরকে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। ‘অপরাধ’, দলিত হয়েও ‘উচ্চবর্ণের মতো’ জিন্স, গলায় চেন পরেছিল। শহরে চুল কাটাতে গিয়ে উচ্চবর্ণের রক্তচোখের সামনে পড়ে যায় সে। চাষিদের জমি নিয়ে এখানে একটি বড় গাড়ি কারখানা হয়েছে। সার সার গাড়ি, অনেক রোজগার, নতুন টাউনশিপ, বিদেশি হোটেল— সেজে উঠছে উপনগরী। বড় রাস্তার এক দিকে পটেল, রাজপুত, ঠাকুরদের বসতি। অন্য দিকে দলিতদের গ্রাম সীতাপুর। উন্নয়নের প্রদীপের নীচেই বিভাজনের অন্ধকার।
পড়ন্ত বেলায় মন্দিরের দালানে জিরোচ্ছেন রাঠোর মুকেশ, বিষ্ণু মকুয়ানারা। দলিতদের মহল্লা। এ মন্দিরে বসেই দেখা যাচ্ছে, রাস্তার ও-পারে আরও একটি মন্দিরের চুড়ো। “ও-পারে রামজির মন্দির। কিন্তু আমরা সে মন্দিরে পুজো দিতে পারি না। গেলেই উচ্চবর্ণেরা মারধর করে। আমরা শুধু আমাদের চামুণ্ডা মন্দিরেই পুজো দিই,” বললেন মুকেশ, “বিজেপির যত উন্নয়ন ও-পাড়ায়। আমাদের দিকে মুখও ফেরায় না। বিজেপিকেও আমরা এখন আর ঢুকতে দিই না।” “কংগ্রেস ক্ষমতায় আসুক না-আসুক, সুখে-দুঃখে সঙ্গে থাকে। তাই আমাদের পুরো গ্রামের ভোট যায় কংগ্রেসে,” যোগ করলেন বিষ্ণু।
মনে পড়ে গেল এ রাজ্যেরই প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সুরেশ মেটার কথা। যিনি বিজেপি থেকেই মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু বিজেপিতে নরেন্দ্র মোদীর কাজের ধরন পছন্দ হয়নি। মোদীর বিরোধিতা করেই দল ছেড়েছেন। সুরেশের মতে, “কারসাজিতে বিজেপির জুড়ি মেলা ভার। সর্দার পটেলের মূর্তি তৈরি করতেই সাতটি গ্রাম উচ্ছেদ হয়েছে। দলিতদের উপরে অত্যাচার হচ্ছে। কৃষকেরা আত্মহত্যা করছেন। কিন্তু বিজেপির রাশ এতটাই মজবুত যে, সংবাদমাধ্যমে আসল খবর আসতে পারে না।”
গত কয়েক দিন গুজরাত ঘুরে এমন অনেক টাটকা খবর কানে এল, যা সত্যিই সে ভাবে শিরোনামে আসেনি। ১) মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণীর গড় রাজকোটে ৩৬ জন চাষি ফসল নষ্টের পরে বিমার টাকা পাননি। আত্মহত্যার হুমকি দিয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখেছেন। ২) খোদ কৃষিমন্ত্রীর এলাকা জামনগরে কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। ৩) ভাবনগরে ৯০০ গ্রামের চাষিরা বিজেপির বিরুদ্ধে ভোটের ডাক দিয়েছেন। ৪) ২০ হাজার রাজ্য সরকারি কর্মী ‘নোটা’তে ভোট দেওয়ার পণ করে মাথা ন্যাড়া করেছেন। ৫) আরাবল্লী জেলায় ভিলোড়াতে ভোট বয়কটের ডাক দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। ৬) মোদীর শ্বশুরবাড়ির এলাকার বাসিন্দাদের ক্ষোভের চোটে বিজেপি প্রার্থী প্রচারও শুরু করতে পারেননি। ৭) ভারুচ হাসপাতালে মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে চাকরি গিয়েছে এক মহিলার। ৮) সাবরমতীতে এখনও ভাসছে বাতিল নোট। ৯) দ্রুত হারে বেকারত্ব বাড়ছে নরেন্দ্র মোদীর রাজ্যে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
“নরেন্দ্র মোদীর ‘গুজরাত মডেল’ কী জানেন?” জানাচ্ছেন কংগ্রেসের নেতা শক্তিসিন গোহিল। যিনি আজও দিল্লিতে ‘গুজরাত ভবনে’ একা লিফটে চড়েন না। পাছে মোদী কোনও ভাবে ফাঁসিয়ে দেন! মোদী যখন মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, গোহিল ছিলেন বিরোধী দলনেতা। এগারো জন গোয়েন্দা নাকি সর্বক্ষণ নজর রাখতেন তাঁর উপরে। তাঁর মতে, “মডেলটি হল, মুষ্টিমেয় শিল্পপতির সুবিধা করা আর বাকিদের উপেক্ষা করা। আর অসন্তোষের সুর যাতে বাইরে না আসে, তার জন্য দু’টি পথ। এক, ভয় দেখানো। দুই, অন্য কোনও বিষয় নিয়ে এত ঢাক পেটানো যাতে বাকি আওয়াজ শোনাই না-যায়। কিন্তু ধীরে ধীরে মুখোশটা খুলছে।”
পরিসংখ্যান বলছে, কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। গুজরাতে বদল হচ্ছে। তবে ধীর গতিতে। ২০০২ সাল থেকে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির আসন সংখ্যা ক্রমশ কমেইছে, বাড়েনি। বাড়ছে কংগ্রেসের। তবে দু’টোই খুব ধীর গতিতে। যদিও গত লোকসভায় মোদী-ঝড়ে ছবিটি ছিল ব্যতিক্রম। ‘গুজরাত অস্মিতা’র তাসে সব আসনই যায় মোদীর ঝুলিতে।
এ বার কতটা বদল ঘটাবে গুজরাত? বেচারাজির বিষ্ণু-মুকেশদের আওয়াজ কি শুনবে ভোটবাক্স?
হ্যাঁ, বেচারাজির নাম শুনে কিছু পাঠকের কৌতূহল বাড়তেই পারে। তাঁদের জন্য বলে রাখা, এটি গুজরাতের মেহসানা জেলার একটি মন্দির শহর। মাতা বহুচেরা আরাধ্য দেবী। গুজরাতের তিন শক্তিপীঠের মধ্যে একটি বলে ধরা হয়। বহুচেরাজি, অনেকের মতে বেচারাজি।