মরা লোককে বাঁচাবে! খবর করে দেবো

সরু সরু গলির মানচিত্র একেই বেশ জটিল। সেই চার বছর আগে আখলাকের খুনের ঘটনার পরে প্রথম বার এসেছিলাম দাদরি পরগনার এই বিসারা গ্রামে।

Advertisement

অগ্নি রায়

দাদরি শেষ আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৫৬
Share:

আখলাকের বাড়ি। নিজস্ব চিত্র

“এত দিন পরে মরা লোককে খুঁজতে এসেছ কেন? বাঁচিয়ে তোলার মতলব আছে নাকি! বেশি খোঁজাখুঁজি করলে গোটা গ্রামে খবর করে দেবো!”

Advertisement

সরু সরু গলির মানচিত্র একেই বেশ জটিল। সেই চার বছর আগে আখলাকের খুনের ঘটনার পরে প্রথম বার এসেছিলাম দাদরি পরগনার এই বিসারা গ্রামে। সেই বাড়ি ফের চিনে নিয়ে পৌঁছে যাওয়া কার্যত অসম্ভব এবং সেই জন্যই ঠোকা খেতে খেতে কাছাকাছি এসে সিঁড়িতে বসা মধ্যবয়স্ক এক মহিলার কাছে পথ জানতে চাওয়া। উত্তর যা এল, তা উঁচু গলার হুমকি! অথচ এই গলির থেকে পঞ্চাশ ফুট দূরেই টহল দিচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে পুলিশ ভ্যান। কিছু বাড়িতে ঢুকে রয়েছে মেশিনগান হাতে সেনাও।

কারণ, কিছু ক্ষণের মধ্যেই হেলিকপ্টার চড়ে বিসারায় নামছেন যোগী আদিত্যনাথ!

Advertisement

অমৃতসর থেকে এসে দেখছি, উত্তরপ্রদেশের গরম অনেকটাই বেশি। বাজরা আর গমখেতের মাঝখান দিয়ে সরু সিঁথির মতো রাস্তা এসে পড়েছে বিসারা গ্রামের সামনে।
যেখানে পৌঁছলে বোঝা অসম্ভব, মাইল দেড়েক দূরেই জিটি রোড দিয়ে নাগরিক জীবন ছুটে যাচ্ছে গ্রেটার নয়ডা থেকে গৌতম বুদ্ধনগরের দিকে। আরও অবাক যে, সাতসকালেই উত্তরপ্রদেশের পুলিশ অলিগলি. খাটাল, ঘুঁটের পাহাড় আর ক্ষয়াটে ঘরদোর সংবলিত বিসারা গ্রামটিকে কার্যত দুর্গ বানিয়ে ফেলেছে। অন্তত তিন কিলোমিটার আগে থেকে রাস্তা বন্ধ। রোদ চড়া হচ্ছে দেখে প্রেস কার্ড দেখিয়ে গাড়ি নিয়ে ভিতরে
যেতে দিতে অনুরোধ করলাম। চিঁড়ে ভিজল না।

একটু পরেই যে এখানে পৌঁছে যাবেন আদিত্যনাথ!

আজ কোথায় কোথায় ভোট, দেখে নিন

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

অবশেষে পৌঁছনো গেল আখলাকের বাড়ির সামনে। অবাকই লাগল। চার বছর আগে এই নীল দরজাটি যেমন তালাবন্ধ দেখে গিয়েছিলাম, হুবহু তেমনটিই রয়েছে। সময় যেন থমকে রয়েছে এখানে। না, পুরো থমকে হয়তো নেই। বাড়ি ফুঁড়ে উঠেছে অশ্বত্থ গাছ। “চার বছরে কেউ আসেনি এখানে। ওরা ছিল চার ভাই। আখলাকের নিজের দুই ছেলে। সেই যে পিটিয়ে মারল ওকে এবং তার পরে সেই যে গ্রামছাড়া হল ওরা, আর কেউ ফিরে এল না। না, আমরা জানি না, ওদের কে কোথায় আছে। শুনেছি, গ্রেটার নয়ডায় থাকে।”

কপাটবন্ধ নীল দরজার লাগোয়া বাড়িটিতে কড়া নাড়ায় বেরিয়ে এলেন এক রাজপুত রমণী। নাম মঞ্জু। না, এঁর মধ্যে তত বিদ্বেষ বোধ হয় নেই। তাই কাঁসার গ্লাসে জলের সঙ্গে দু’‌টো চিনির মঠও এসেছে। “লোক তো খারাপ ছিল না। সহজ, সরল, গায়ে-গতরে খাটা জিন্দা দিল আদমি। কিন্তু দোষ করলে কী করা যাবে! ওর ফ্রিজেও তো গাই মাতার মাংস পাওয়া গিয়েছিল। তাই লোকে শাস্তি দিয়েছে।” রোষোন্মত্ত জনতা যখন আখলাকের বাড়িতে ঢোকে, কী জানি হয়তো ইনিও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাশা দেখেছেন। আগেই একটি কামড় দেওয়া চিনির মঠ এত তেতো লাগছে যে, ফেলে দেওয়ার জন্য পকেটে ঢুকিয়ে নিতে হল।

গোবরের গন্ধে ম-ম করা যে-সব গলি দিয়ে রিকশা চললেও হাঁটতে সমস্যা হয়, আজ সেখানে গেরুয়া পতাকা লাগানো বাহুবলী জিপ, ভ্যানে ছয়লাপ। স্লোগান মুখরিত বিসারা— ‘নরেন্দ্র মোদী জিন্দাবাদ, পাকিস্তান মুর্দাবাদ!’ পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের এই ছোট্ট জনপদে দেখলাম, বিরোধী দলের সঙ্গে পাকিস্তানকে মিলিয়ে-মিশিয়ে এক করে দেওয়া হয়েছে।

ছটাক জমিসর্বস্ব অথবা ভূমিহীন খেতমজুরদের আড্ডায় আখলাককে নিয়ে তৈরি হচ্ছে বিজাতীয় মিথ। এমনই এক আড্ডা বসেছে রমেশ সিংহের দাওয়ায়। একটি হুঁকোকে ঘিরে বেশ কিছু চরিত্র। তাঁদেরই এক জন, রমেশ সিংহ বললেন,
“আমরা তো শান্তিপ্রিয়। ঝুটঝামেলায় থাকি না এমনিতে। কিন্তু আখলাখ তো বিনা ভিসায় পাকিস্তান যেত। ওখান থেকে নোট ছাপানোর মেশিন নিয়ে এসেছিল। অখিলেশের পার্টির সঙ্গেও সাঁট ছিল খুব। দেখলেন না, মরে যাওয়ার পরে এত টাকা দিয়েছে ওদের পরিবারকে, গাঁয়ে ফেরার নামও করছে না!” ওঁদের মুখেই জানা গেল, আওরঙ্গজেবের আমলে বর্ধিষ্ণু রাজপুত পরিবারদের দেওয়া টাকায় মসজিদ গড়ে উঠেছিল এই প্রাচীন গ্রামে। এখন এখানে সাকুল্যে গোটা চল্লিশেক মুসলমান পরিবার টিকে রয়েছে। বংশানুক্রমিক ভাবে ধোপা, লোহারের কাজ করা
এখানকার মুসলমানদের নিরাপত্তার সমস্যা বড় একটা ছিল না। আখলাক-হত্যার পরে দলে দলে বিসারা ছেড়েছেন তাঁরা।

“গোটা দেশ এই গ্রামের চিন্তাভাবনার সঙ্গে পরিচিত। এখানে আসার অনেক দিনের ইচ্ছা আমার। বিসারা কাউকে ছেড়ে কথা বলে না। দেশের ঐতিহ্য, স্বাভিমান নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তা সহ্য করে না। পাকিস্তানও এ কথা জানে।”

আখলাক-হত্যায় জামিনে ছাড়া পাওয়া অভিযুক্তেরা প্রথম সারিতে। হেলিকপ্টার থেকে নেমে মঞ্চে উঠে এ ভাবেই বক্তৃতা শুরু করে দিয়েছিলেন যোগী আদিত্যনাথ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন