ছেলের হয়ে প্রচারের ফাঁকে মন্দিরে বসুন্ধরা রাজে। নিজস্ব চিত্র
মেবারের রাজধানী উদয়পুরে তাঁর দেখা মেলেনি।
‘সূর্য শহর’ জোধপুরেও তিনি নেই।
অজমের-পুষ্কর ঘুরে রাজস্থানের রাজধানী ‘গোলাপি শহর’ জয়পুরেও তাঁর দেখা মিলল না।
না। বসুন্ধরা রাজে কোথাও নেই।
কে বলবে, মাস চারেক আগেও তিনি রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীর পদে ছিলেন। বিধানসভা ভোটে গদি খুইয়ে বসুন্ধরা রাজে লোকসভা ভোটের প্রচার থেকেই উধাও।
ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান—গত বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরে লোকসভা ভোটের সেমিফাইনালে তিন রাজ্যে ক্ষমতা হারিয়েছিল বিজেপি। ছত্তীসগঢ়ে বিজেপি লোকসভা ভোটে একেবারে নতুন দল নামালেও, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহই এখনও দলের অধিনায়ক। প্রচারে নরেন্দ্র মোদীর পাশে রমনেরই মুখ। মধ্যপ্রদেশে তো প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চহ্বাণই লোকসভা ভোটে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু রাজস্থানে একেবারে ভিন্ন ছবি। শুধুই নরেন্দ্র মোদী। বসুন্ধরার নাম-ছবিই নেই বিজেপির প্রচারে।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
গ্বালিয়য়ের সিন্ধিয়া পরিবারের কন্যা বসুন্ধরার বিয়ে হয়েছিল রাজস্থানের ঢোলপুরের মহারাজ রাণা হেমন্ত সিংহের সঙ্গে। কয়েক বছরের মধ্যেই বিচ্ছেদ। তার পরে রাজনীতি। ক্রমশ মুখ্যমন্ত্রীর গদি। এখন কোথায় সেই ঢোলপুরের প্রাক্তন মহারানি?
উত্তর মিলল, ঝালাওয়ারে। সোমবার রাজস্থানের প্রথম দফার ভোটে ঝালাওয়ারেই ছেলে দুষ্যন্ত ও পুত্রবধূ নীহারিকাকে নিয়ে ভোট দিয়েছেন বসুন্ধরা। ছেলে, সাংসদ দুষ্যন্ত এ বারও ঝালাওয়ারে বিজেপির প্রার্থী। সেখানেই ছেলের হয়ে ভোটের প্রচারে বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন তিনি। প্রচারের ফাঁকে ছেলে-বউমাকে নিয়ে মন্দিরে গিয়েছেন। কংগ্রেস নেতারা কটাক্ষ করে বলছেন, বসুন্ধরা আসলে প্রার্থনা করেছেন, তাঁর উপরে জনতার ‘রাগ’ যেন ছেলের উপরে না এসে পড়ে।
কিসের রাগ? জয়পুরের হাওয়ামহলের সামনে থেকে চাঁদপোল পর্যন্ত গোলাপি রঙে রাঙানো ত্রিপোলিয়া বাজারে রামচন্দ্র আগরওয়ালের তিন পুরুষের জামাকাপড়ের ব্যবসা। তিন পুরুষ ধরেই বিজেপির সমর্থক তাঁরা। রামচন্দ্রের অভিযোগ, ‘‘বসুন্ধরার আমলে আমরা সবাই জানতাম, এইট পিএম, নো সিএম। রাত আটটার পরে আর মুখ্যমন্ত্রীর খোঁজ মিলবে না। কতবার দরবার করেছি, ত্রিপোলিয়া বাজারে একটাও মহিলাদের শৌচালয় নেই। পাত্তাই দিতেন না। বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী যদি ব্যবসায়ীদের কথা না শোনেন, রাগ তো হবেই। মুখ্যমন্ত্রী আমাদের পাত্তা দিতেন না বলে পুলিশ-প্রশাসনও হেনস্থা করত।’’ রাজনীতিতে নেমেও ‘মহারানি’-র মতো আচার-আচরণ বিজেপির অনেক নেতারই পছন্দ ছিল না।
এই রাগ টের পাওয়া গিয়েছিল রাজস্থানের বিধানসভা ভোটেই। আমজনতা তো বটেই, বিজেপির কট্টর সমর্থকেরাও বসুন্ধরার উপরে চটে ছিলেন। স্লোগান উঠেছিল, ‘মোদী তুঝসে বৈর নেহি, বসুন্ধরা তেরি খৈর নেহি’। অর্থাৎ, মোদীর সঙ্গে শত্রুতা নেই। কিন্তু বসুন্ধরার ক্ষমা নেই। ভোটের বাক্সে জনতা ক্ষমা করেওনি।
বিজেপি নেতাদের আশা, বসুন্ধরাকে সরিয়ে জনতা রাগ মিটিয়েছে। এবার তাঁরা নরেন্দ্র মোদীকে ভোট দেবেন। তা শুনে কংগ্রেস মুখপাত্র স্বর্ণিম চতুর্বেদীর কটাক্ষ, ‘‘বসুন্ধরাকে প্রচারে নামালে বিজেপির ভোট কমবে বুঝেই তাঁকে প্রচারে নামানো হয়নি।’’
মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় বসুন্ধরাকে দেখা যেত ললিত মোদীর পাশে, জয়পুরের স্টেডিয়ামে, আইপিএল-এ রাজস্থান রয়্যালসের ম্যাচের সময়। দেশ ছেড়ে পালানো ললিতের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের পাশাপাশি ব্যবসায়িক লেনদেনও ছিলও বলে অভিযোগ ওঠে। বসুন্ধরার অনুগামীদের পাল্টা যুক্তি, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বসুন্ধরাই চাষিদের ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঋণ মকুব করে গিয়েছিলেন। ফলে
কংগ্রেসের সরকার এসে ২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ঋণ মকুব করেও বিশেষ ফায়দা তুলতে পারেনি। তাছাড়া, বসুন্ধরা জয়সলমেরে প্রচারে গিয়েছেন। জোধপুরে বিজেপি প্রার্থী, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গজেন্দ্র সিংহ শেখাওয়াতের হয়ে অমিত শাহর সঙ্গে ‘রোড শো’ করেছেন। যে শেখাওয়াতকে বসুন্ধরার আপত্তিতেই অমিত রাজ্য সভাপতি করতে পারেননি।
বিজেপির নেতারা বলছেন, এবার অমিতের চাপেই বসুন্ধরাকে জোধপুরে ‘রোড শো’ করতে হয়েছে। প্রার্থী তালিকা তৈরির সময়ও নানা আপত্তি তুলেছিলেন বসুন্ধরা। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব তাতে কান দেননি। বসুন্ধরার পছন্দের অনেকে টিকিট পাননি। তাতে আরও গোসা হয়েছে ‘মহারানি’র। তিনি দলীয় নেতৃত্বের সঙ্গে আরও দূরত্ব বাড়িয়েছেন। আর আজ ভোট দিয়ে বসুন্ধরা বলেছেন, ‘‘নরেন্দ্র মোদীকে ফের প্রধানমন্ত্রী করার জন্য যথেষ্ট উৎসাহ রয়েছে।’’
পাঁচ বছর আগে রাজস্থানে বিজেপি ২৫-এ ২৫টি আসন পেয়েছিল। এবারও বিজেপি ২৫টিই আসন পাবে বলে বসুন্ধরা দাবি করেছেন। কিন্তু আসলে তিনি দেখতে চাইছেন, তাঁকে বাদ দিয়ে দল ক’টা আসন পায়! ভোটের ফল তাই উত্তর দেবে, রাজনীতিতে রাজের ইনিংস এখানেই শেষ না কি আরও বাকি!