‘স্বাস্থ্য’হীন কেন্দ্রে ভোট কি আবার ‘নোটা’য়!

৫ বছর পরেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তা ‘নোটা’ ঘিরেই। প্রচারে গিয়ে তাঁরা বারবারই বলছেন ‘‘ভোটটা কিন্তু সঠিক ভাবে দিতে হবে। এ বার সেটা খেয়াল রাখবেন।’’

Advertisement

সোমা মুখোপাধ্যায়

নীলগিরি শেষ আপডেট: ২৭ মার্চ ২০১৯ ০৪:৫৩
Share:

রাজনৈতিক সমাবেশের এই ভিড় কি ভোটেও প্রতিফলিত হবে।

চারপাশে চোখ জুড়নো সবুজ, আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা। বিকেলের পরে এক ধাক্কায় রাত নেমে আসা এমন আপাত নিস্তরঙ্গ জীবনেও আগুন লুকিয়ে আছে। প্রতিবাদের সেই আগুন প্রতিফলিত হয়েছিল ভোটযন্ত্রে। পাঁচ বছর আগে। গোটা দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোটার ‘নোটা’ (নান অব দি অ্যাবভ) বেছে নিয়েছিলেন তামিলনাড়ুর নীলগিরিতে। মোট ৪৬ হাজার ৫৫৯ জন। ভোটার মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষকদের কাছে বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে গিয়েছিল এই লোকসভা কেন্দ্র।

Advertisement

৫ বছর পরেও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের চিন্তা ‘নোটা’ ঘিরেই। প্রচারে গিয়ে তাঁরা বারবারই বলছেন ‘‘ভোটটা কিন্তু সঠিক ভাবে দিতে হবে। এ বার সেটা খেয়াল রাখবেন।’’

এই ‘সঠিক ভাবে’ টা কী? চারপাশ দেখে নিয়ে নেতারা গলা নামিয়ে বলছেন, ‘‘বুঝছেন না? নোটা! জেতাহারা নির্ভর করতে পারে এর উপরেই।’’ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে এডিএমকে প্রার্থীর সঙ্গে ডিএমকে প্রার্থীর ভোটের ব্যবধান ছিল ১ লাখেরও বেশি। আর কংগ্রেস প্রার্থী পেয়েছিলেন ৩৭ হাজার ভোট। অর্থাৎ কংগ্রেসের চেয়ে ‘নোটা’র ভাগ্যে জুটেছিল বেশি ভোট। অথচ এই নীলগিরি কেন্দ্র থেকে অতীতে সবচেয়ে বেশি বার (৭ বার) জিতেছে কংগ্রেস। তখন অবশ্য কেন্দ্রটি সংরক্ষিত ছিল না। ২০০৯ সালে নীলগিরি সংরক্ষিত কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়।

Advertisement

‘‘অন্য ভাবেও দেখতে পারেন।’’ কুন্নুরের রাস্তায় চায়ের দোকানে কাপ ধুতে ধুতে বৃদ্ধ নাগার্জুন বলছিলেন, ‘‘হয়তো উচ্চবর্ণের লোকেরা দলিত কিংবা নিম্নবর্ণের প্রার্থীকে ভোট দেওয়ার চেয়ে কাউকেই ভোট না দেওয়াটা পছন্দ করেছেন।’’

আরও পড়ুন: দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

নাগার্জুনের মতো করে ভাববার মানুষ হয়তো সংখ্যায় কম। উটির বাজারে, মারিয়াম্মান মন্দিরের সামনে কুন্নুরের সিমস পার্কে কিংবা সমতলের মেট্টুপালায়মের বহু মানুষের সঙ্গে কথা বলে আবার উঠে এসেছে অন্য প্রসঙ্গ। তাঁরা জানিয়েছেন, গতবারের ভোটে নীলগিরিতে ‘নোটা’ বেশি পড়ার অন্য কারণ ছিল। এক দিকে, ডিএমকে প্রার্থী আন্দিমুথু রাজার বিরুদ্ধে ১ লক্ষ ৭৬ হাজার কোটি টাকার টুজি স্পেকট্রাম দুর্নীতির অভিযোগ, অন্য দিকে এডিএমকে প্রার্থী সি গোপালকৃষ্ণন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণার অভাব। দুইয়ের মিলিত হতাশা থেকে হাজার হাজার ভোটার ‘নোটা’ বেছে নিয়েছিলেন।

তামিলনাড়ুর মানবাধিকারকর্মী আর বিজয় জানান, পাহাড় এবং সমতলে গরিব মানুষের জমির অধিকার নিয়ে এখানে জটিলতা রয়েছে। সেগুলি নিয়ে জনপ্রতিনিধিরা মাথা ঘামান না। তাই ঝকঝকে রাস্তা কিংবা বিদ্যুতের সুবন্দোবস্তও মানুষের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে পারেনি।

আর একটি বিষয় ‘নোটা’র পিছনে কাজ করেছে বলে মনে করছেন নীলগিরির ভোটারদের একটি বড় অংশ। তা হল স্বাস্থ্যের অধিকার। কলেজ শিক্ষক এস শিবকুমার কিংবা ব্যাঙ্ক চাকুরে আর গোপীনাথ, ছোট ব্যবসায়ী অ্যানি কুমার—সকলেই জানিয়েছেন, ভোটপ্রার্থীদের প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও নীলগিরির মানুষ এখনও স্বাস্থ্যের অধিকার থেকে অনেকটাই বঞ্চিত। এই কেন্দ্রে এখনও পর্যন্ত সরকারি সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল নেই। যে উটিতে বছরে ৩০ লক্ষ পর্যটক বেড়াতে আসেন, সেখানে একটিই মাত্র সরকারি হাসপাতাল। কুন্নুরে একটি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। কিন্তু কোথাও ‘স্পেশ্যালিটি কেয়ার’ এর বন্দোবস্ত নেই।

‘ন্যাশনাল কমিউনিকেবল ডিজি‌জ কন্ট্রোল বিভাগে’র সমীক্ষা অনুযায়ী, এই পাহাড়ি এলাকায় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের মধ্যে ১৬ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপ এবং ১০ শতাংশ ডায়াবিটিসে ভোগেন। এই দু’টি অসুখের সঙ্গেই হার্টের অসুখের নিবিড় যোগাযোগ রয়েছে। অথচ সরকারি হাসপাতালে ৪০০-র বেশি শয্যা থাকলেও হার্টের রোগীর চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই। নেই নিউরোলজি, নেফ্রোলজি, গ্যাস্ট্রোএনটেরোলজি কিংবা প্লাস্টিক সার্জারির ব্যবস্থাও। বড়সড় অসুখ হলে নীলগিরির মানুষকে ছুটতে হয় ৮০ কিলোমিটার দূরে কোয়ম্বত্তূরে। এমনকি, প্রসবকালীন জটিলতা হলে প্রসূতির দশাও হয় একই।

মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন জয়ললিতা একাধিক বার কুন্নুরে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বাস্তবে কিছুই হয়নি। এ বার ডিএমকে প্রার্থী এ রাজার প্রতিশ্রুতি, ‘‘আমার প্রথম কাজই হবে কুন্নুরে মেডিক্যাল কলেজ তৈরির ব্যবস্থা করা।’’ এডিএমকে প্রার্থী ত্যাগরাজনও ঠারেঠোরে তা-ই বলেছেন। ২০১৪ র নোটার ‘স্মৃতি’ কতটা ভাবাচ্ছে? ডিএমকে প্রার্থী রাজার উত্তর, ‘‘গত বার ব্যতিক্রমী সময় ছিল। এ বার আর তা হবে না।’’ এডিএমকে প্রার্থী ত্যাগরাজনের গলায় তাচ্ছিল্য, ‘‘নোটা একটা ভাবার বিষয় হল? আগে যা হয়েছে হয়েছে। এ বার মানুষ দোলাচলে না থেকে আমাদেরই ভোট দেবেন।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন