নোকিয়ার দেশে প্রণবের বার্তা, মেক ইন ইন্ডিয়া

এলেন ‘নোকিয়ার’ দেশে! বললেন, “এসো ভারতে বানাও”। একুশ হাজার কোটি টাকা করের চাপে চেন্নাইয়ে তাদের সবেধন হ্যান্ডসেট তৈরির ইউনিটে এরই মধ্যে তালা ঝুলিয়েছে নোকিয়া। তাতে কী! কর-জটের নিষ্পত্তির ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অভিযানকে ফিনল্যান্ড তথা ইউরোপের মাটিতে এনে ফেললেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।

Advertisement

শঙ্খদীপ দাস

হেলসিঙ্কি (ফিনল্যান্ড) শেষ আপডেট: ১৬ অক্টোবর ২০১৪ ০৩:৩৭
Share:

ফিনল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী অ্যালেকজান্ডার স্টাবের সঙ্গে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ছবি: রয়টার্স।

এলেন ‘নোকিয়ার’ দেশে! বললেন, “এসো ভারতে বানাও”।

Advertisement

একুশ হাজার কোটি টাকা করের চাপে চেন্নাইয়ে তাদের সবেধন হ্যান্ডসেট তৈরির ইউনিটে এরই মধ্যে তালা ঝুলিয়েছে নোকিয়া। তাতে কী! কর-জটের নিষ্পত্তির ইঙ্গিত দিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ অভিযানকে ফিনল্যান্ড তথা ইউরোপের মাটিতে এনে ফেললেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।

গত তিন দিন ধরে নরওয়ে ও আজ হেলসিঙ্কিতে দাঁড়িয়ে এই একটি মন্ত্রই বারবার ইউরোপের কানে পৌঁছে দিতে চাইলেন তিনি। নরওয়ের রাজা পঞ্চম হেরাল্ডের সঙ্গে নৈশভোজ, প্রধানমন্ত্রী এরনা সোলবার্গের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ বৈঠক, ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট সাওলি নিনিস্তোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলাপচারিতা এবং স্ক্যানডিনেভিয় এই দুই রাষ্ট্রের বণিক ও শিল্পপতিদের সঙ্গে আলোচনা— সবেতেই তাঁর ঠোঁটের গোড়ায় ঘুরে ফিরে সেই এক মন্ত্র।

Advertisement

রাষ্ট্রপতির মূল বার্তা, পরিবর্তনের হাওয়া বইছে ভারতে। দেশে স্থায়ী সরকার এসেছে। বিদেশি বিনিয়োগের পথ সুগম করতে সরকার নতুন পদক্ষেপ করেছে। রেল, প্রতিরক্ষা, বিমায় বিদেশি বিনিয়োগের জন্য দরজা আরও খুলে দেওয়া হয়েছে। উৎপাদন বাড়াতে দক্ষ শ্রমিক তৈরির যোজনা নিয়েছে। তা ছাড়া মন্দার মার কাটিয়ে আন্তর্জাতিক অর্থনীতির ঘাড় ক্রমশ শক্ত হওয়ায় ভারতেও বৃদ্ধির সবুজ অঙ্কুর দেখা যাচ্ছে। এই তো সময়! ভারতে বিনিয়োগ করুন। প্রযুক্তি হস্তান্তর করে ভারতে পণ্য উৎপাদন করুন। এবং চলুন বৃদ্ধির পথে উভয়েই হাত ধরাধরি করে এগোই।

দেশে বিনিয়োগ টানতে সাম্প্রতিক অতীতে কোনও রাষ্ট্রপতিকে এতটা সক্রিয় দেখা গিয়েছে কি! রাষ্ট্রপতি সরকারের বিদেশ, অর্থ এবং রাজনীতির সূত্র আওড়াবেন সেটাই দস্তুর। কিন্তু কথায়, ভাষায় এতটা আগ্রাসী হয়ে রাষ্ট্রপতি অর্থনীতিতে, বিদেশনীতিতে কার্যকরী ভূমিকা নেবেন— গত দেড় দশকে এমনটা কার্যত দেখা যায়নি বলেই মত সাউথ ব্লকের কর্তাদের।

কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির এক ‘অভূতপূর্ব’ তালমিলে এখন সেটাই যে বাস্তবের চেহারা নিয়েছে, তা দৃশ্যত স্পষ্ট। ভারতীয় কূটনীতিকদের মতে, দেশের প্রশাসনিক ও সাংবিধানিক প্রধান অন্তত একটি বিষয়ে একমত। তা হল,- একুশ শতকে বাণিজ্যেই বসত করবে বিদেশনীতি। কেন্দ্রে সরকার গঠনের পর ১৫ অগস্ট লালকেল্লা থেকে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ মন্ত্র ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তার পর সেই অভিযানের শরিক এখন রাষ্ট্রপতিও।

বস্তুত নয়াদিল্লিতে মোদী সরকার গঠনের পর ‘আচ্ছে দিন’ নিয়ে আশার বার্তা সুদূর এই বাল্টিক সাগরের তীরে আগেই পৌঁছেছে। এমনকী ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট আজ জানালেন, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র প্রচার নিয়ে তিনিও অবগত। নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ারে ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে উচ্ছ্বাস ও প্রবাসীদের প্রত্যাশা তাঁরাও দেখেছেন।

সেই আবেগ ও রোমান্টিকতা অবশ্য এক দিকে। অন্য দিকের বাস্তব হল, ইউরোপের যে সব শিল্পসংস্থা ভারতের বাজারে ডলার- ইউরো ঢেলেছে, হাতেকলমে তাদের লাল ফিতের অভিজ্ঞতাও কম নয়। মোদী ক্ষমতায় আসায়, দুর্নীতি, কর কাঠামোয় জটিলতা নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ যে রাতারাতি উবে গেছে তাও নয়! বরং ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’-র প্রচার করতে গিয়ে সেই সব প্রশ্নের মুখেও পড়তে হয়েছে ভারতের রাষ্ট্রপতিকে।

তবে যত্নশীল ভাবে তার উত্তরও দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি। অসলো আর হেলসিঙ্কিকে জানিয়েছেন, দুর্নীতি নিয়ে ঘরোয়া রাজনীতিতে উদ্বেগ ছিল। তবে দুর্নীতি মোকাবিলায় যে লোকপাল বিল ষাট বছর ধরে সংসদের সিঁড়িতে গোঁত্তা খেয়ে বারবার ফিরে গিয়েছে, সেটি এখন পাশ হয়েছে। পাশাপাশি, লাল ফিতের জটিলতা কাটাতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে খুবই তৎপর। এ সংক্রান্ত প্রক্রিয়া যথাসম্ভব সরল করা হচ্ছে।

সাউথ ব্লকের এক কর্তার কথায়, রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় ঠিক যে ভাবে দেশে পরিবর্তিত বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন, তাঁর কাছ থেকে সেটাই প্রত্যাশা ছিল। ওই কূটনীতিকটির মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মানুষের সঙ্গে জোড়ার রাজনৈতিক দক্ষতা রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় কর-ইত্যাদি বিষয়ে খুঁটিনাটি ব্যাখ্যা করার কিছুটা সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। সেখানেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছেন প্রণববাবু।

আর তাঁর সফরের মধ্যেই ফিনল্যান্ডের প্রেসিডেন্ট জানিয়ে দিলেন, তিন বছরের মধ্যে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য দ্বিগুণ করবে হেলসিঙ্কি।

রাষ্ট্রপতির এই সফরে সঙ্গী হয়েছেন আসানসোলের বিজেপি সাংসদ বাবুল সুপ্রিয় বড়াল। সব দেখে বিজেপি সাংসদের মন্তব্য, “রাষ্ট্রপতির পদ জানতাম আলঙ্কারিক। বিদেশনীতি ও কূটনীতিতে তিনি এতটা কার্যকরী হয়ে উঠতে পারেন, সেটা এ বার চাক্ষুষ করলাম!”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন