মালগাড়ি বাদ পড়েছে আগেই। সাধারণ প্যাসেঞ্জার ট্রেন—ব্রাত্য তা-ও। পরিবর্তে মাওবাদীদের নতুন চাঁদমারি এখন রাজধানী এক্সপ্রেস।
মঙ্গলবার মাঝ রাতে বিহারের ইসমাইলপুর ও রফিগঞ্জের মধ্যে লাইনের তলায় বিস্ফোরণ ঘটায় মাওবাদীরা। সেখান দিয়ে তখন যাওয়ার কথা একাধিক রাজধানীর। যাত্রীদের গায়ে এর আঁচ না পড়লেও লাইনচ্যুত হয় পাইলট ইঞ্জিন। এক মাসও হয়নি, মাওবাদী নাশকতায় বিহারের ছপরার কাছে উল্টে গিয়েছিল ডিব্রুগড় রাজধানীও।
এক মাসের মধ্যে যে ভাবে দু’-দু’বার মাওবাদী হানার শিকার দেশের সব থেকে ভিভিআইপি ট্রেন রাজধানী এক্সপ্রেস, তাতে উদ্বিগ্ন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। নতুন এই প্রবণতা দেখে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাবাহিনী মনে করছে, ট্রেনে হামলার প্রশ্নে কৌশলগত অবস্থান পরিবর্তন করেছে মাওবাদীরা। আরও বেশি করে প্রচারে থাকতে ও নিজেদের লড়াইয়ের উদ্দেশ্যকে তুলে ধরতেই পরিকল্পনামাফিক এখন রাজধানীর মতো ট্রেনকে নিশানা বানাচ্ছে তারা।
এর আগে মাওবাদী হানার শিকার হয়ছে রাজধানী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রেলমন্ত্রী থাকাকালীন যেমন ভুবনেশ্বর রাজধানীকে দীর্ঘ ক্ষণ নিজেদের কব্জায় রেখেছিল তারা। কিন্তু একে ব্যতিক্রমী ঘটনা হিসাবেই মনে করে রেল। এখন যে ভাবে বারেবারে রাজধানীকে নিশানা বানানো হচ্ছে তার পিছনে কিন্তু একটা নির্দিষ্ট ছক রয়েছে বলেই মত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। মন্ত্রকের ব্যাখ্যা, এখনও দেশের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন রাজধানী এক্সপ্রেস। ফলে এই ট্রেনে হামলা হলে যে ভাবে প্রচার হবে অন্য ট্রেনের ক্ষেত্রে তা হবে না।
আজ যে সময় বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, তখন ওই লাইনেই যাওয়ার কথা একাধিক রাজধানীর। হামলার ফলে বিভিন্ন স্টেশনে দাঁড়িয়ে পড়ে ভুবনেশ্বর, শিয়ালদহ, হাওড়াগামী রাজধানী এক্সপ্রেসগুলি। আজ পাইলট ইঞ্জিন লাইনচ্যুত হয়ে প্রাণহানি ঠেকিয়েছি ঠিকই কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক মনে করছে ভবিষ্যতে এই ধরনের হামলা আরও বাড়বে। বিশেষ করে রাজধানীর উপর।
একে তো নয়া নিশানা, তায় হামলার জন্য যে সময়কে বেছে নেওয়া হচ্ছে, তা-ও ভাবাচ্ছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের। সাধারণত বর্ষাকালে মাওবাদীরা অভিযান থেকে বিরত থাকে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, “বর্ষাকালে জঙ্গলে ক্লাস চলে মাওবাদীদের। দলীয় দর্শন থেকে শুরু করে কী ভাবে আধুনিক হাতিয়ার-বিস্ফোরক ব্যবহার করতে হয় সেই সম্বন্ধে নতুন ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। চলে ক্যাডার ভর্তি ও রি-গ্রুপিং-র কাজও। ফলে বর্ষাকালে গোটা দেশেই মাওবাদী হামলা কমে যায়।” কিন্তু পূর্ব ভারতে বিশেষ করে বিহার এলাকায় যে ভাবে হামলা হচ্ছে তাতে এখন দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছে কেন্দ্র। ফের হামলার আশঙ্কায় মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে যাত্রিবাহী ট্রেন বিশেষ করে রাজধানীর মতো গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন চালানোর ক্ষেত্রে কোনও ঝুঁকি যাতে না নেওয়া হয়, রেল মন্ত্রককে সে রকমই নির্দেশ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক।
উদ্বিগ্ন রেল মন্ত্রকও। আজকের ঘটনার পর ঝাড়খণ্ড-বিহার-পশ্চিমবঙ্গ ও ওড়িশার ট্রেন চলাচলের উপর বিশেষ ভাবে নজর দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে ফের এক প্রস্থ আলোচনায় বসবে মন্ত্রক। অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে মাওবাদী সমস্যা এখন আগের চেয়ে কম। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের তথ্য বলছে, গত তিন বছরে পশ্চিমবঙ্গে কার্যত মাওবাদী হামলার কোনও তথ্যই নেই। তা সত্ত্বেও ঝুঁকি না নিয়ে খড়্গপুর-আদ্রা ও খড়্গপুর-টাটানগর অংশে রাতে ট্রেন চলাচলের নিরাপত্তজনিত সমস্ত ব্যবস্থা পুনর্বিচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মন্ত্রক। বিশেষ ভাবে জোর দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছে গয়া-মোগলসরাই অংশের নিরাপত্তায়। দিল্লি-হাওড়া লাইনে ওই এলাকাটিই এখন সব থেকে বেশি মাওবাদী অধ্যুষিত।
এ দিন পুলিশি অত্যাচারের প্রতিবাদে বন্ধ ডেকেছিল মাওবাদীরা। তাই এ বার থেকে বন্ধের দিন সকাল বেলার পরিস্থিতি বিবেচনা করে তবেই রাতে ট্রেন চালানোর কথা ভাবা হবে। সামান্যতম হামলার আশঙ্কা থাকলে ঝুঁকি না নিয়ে সেখানে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হবে বলেই প্রাথমিক ভাবে সিদ্ধান্ত মন্ত্রকের। দুর্ঘটনা ঘটলেও যাতে প্রাণহানি এড়ানো যায়, তাই বন্ধে ট্রেনের গতি ৬৫-৭০ কিলোমিটারে বেঁধে দেওয়া হবে। রাজধানীগুলি এখন যে ভাবে এক সঙ্গে চলে তেমনই অন্য যাত্রী ট্রেনগুলির আগেও পাইলট ইঞ্জিন চালানো বাধ্যতামূলক করতে চাইছে রেল মন্ত্রক।
মাওবাদী হানার মোকাবিলা করতে শিয়ালদহ, হাওড়া, খড়্গপুর, পটনা, গয়া, মোগলসরাইয়ের মতো স্টেশনে ‘কুইক রেসপন্স টিম’ রাখার কথাও ভাবা হচ্ছে। আরপিএফ, জিআরপি, আরপিএসএফ জওয়ানদের নিয়ে ২৫ জনের ওই দলের দায়িত্বে থাকবেন ডিভিশনাল সিকিউরিটি কম্যান্ডডেন্ট পদমর্যাদার অফিসার। জোর দেওয়া হয়েছে রাজ্য পুলিশ ও রেল পুলিশের মধ্যে নিয়মিত ভিত্তিতে তথ্যের আদানপ্রদানে। এ ব্যাপারে রাজ্যগুলির কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা চেয়েছে রেল মন্ত্রক।