চিকিৎসায় গাফিলতি: ১৫ বছর ধরে আইনি লড়াই অসুস্থ বৃদ্ধের

কখনও এ রাজ্য, কখনও ত্রিপুরা, কখনও বা দিল্লির জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন ত্রিপুরার এক অসুস্থ বৃদ্ধ। ১৫ বছর ধরে এই লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে বিচার পেলেন তিনি। তবে তাঁর লড়াই এখনও শেষ হয়নি। রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে পাল্টা আবেদন করতে জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনে যাচ্ছেন অভিযুক্ত।

Advertisement

মেহবুব কাদের চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ১৪:০২
Share:

কখনও এ রাজ্য, কখনও ত্রিপুরা, কখনও বা দিল্লির জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন ত্রিপুরার এক অসুস্থ বৃদ্ধ। ১৫ বছর ধরে এই লড়াই চালিয়ে শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে বিচার পেলেন তিনি। তবে তাঁর লড়াই এখনও শেষ হয়নি। রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে পাল্টা আবেদন করতে জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনে যাচ্ছেন অভিযুক্ত।

Advertisement

কেন ১৫ বছর ধরে এই লড়াই চালাতে হল ওই বৃদ্ধকে?

১৯৯৯ সালের সেপ্টেম্বরে আগরতলায় একটি পথ দুর্ঘটনায় জখম হন পূর্ব আগরতলার বাসিন্দা অনুপম ভট্টাচার্য। পেশায় আইনজীবী অনু্পমবাবুকে চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর বাঁ পায়ের ‘ফিমার বোন’ ভেঙে গিয়েছে। স্থানীয় চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে আগরতলা থেকে এনে দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে ভর্তি করানো হয়। অনুপমবাবু বলেন, ‘‘ওই হাসপাতালে আমার বাঁ পায়ে এক হাত লম্বা একটি ইস্পাতের রড বসানো হয়। কিন্তু এক বছর পর ওই রডটি ভেঙে যায়।’’ কয়েক দিন পরেই আগরতলার চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি কলকাতার ওই বেসরকারি হাসপাতালে আসেন। অনুপমবাবুর অভিযোগ, দক্ষিণ কলকাতার ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক তাঁর কথা শুনতে চাননি। উল্টে তাঁরা দুর্ব্যবহার করেন বলে অনুপমবাবুর অভিযোগ। অনুপমবাবু জানান, পরের দিন তিনি ভেলোরে যান। সেখানের চিকিৎসকরা তাঁর পা থেকে ভাঙা রডটি বের করে নতুন একটি রড বসিয়ে দেন।

Advertisement

কলকাতার ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে এর পরে চিকিৎসার গাফিলতির অভিযোগে ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি শুরু করেন অনুপমবাবু। তিনি জানান, মামলা শুরু করতে বাগুইআটির বাসিন্দা আইনজীবী শিবশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের সঙ্গে তিনি টেলিফোনে কথা বলেন। তাঁর দাবি, ২০০১ সালের ১৬ মে শিবশঙ্করবাবুর ঠিকানায় মামলার খরচ বাবদ ৩০ হাজার টাকা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য (এক্স রে প্লেট, প্রেসক্রিপশন ইত্যাদি) পাঠিয়ে দেন অনুপমবাবু। অনুপমবাবুর অভিযোগ, ‘‘এর এক বছর পর ২০০২ সালের মে মাসে পশ্চিমবঙ্গ ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলাটি নথিভুক্ত করা হয়। কিন্তু ওই আইনজীবী এক দিনের জন্যও আদালতে হাজিরা না দেওয়ায় ২০০৩ সালের জানুয়ারি মাসে ওই মামলাটি বাতিল হয়ে যায়।’’

তবে রাজ্য আদালতে মামলা বাতিল হলেও হাল ছাড়ার পাত্র নন অনুপমবাবু। এর পরে পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে ওই বছরেই এক সঙ্গে দু’টি মামলা দায়ের করেন তিনি। কলকাতার বেসরকারি হাসপাতাল কতৃর্পক্ষ ও চিকিৎসকের গাফিলতির পাশাপাশি তাঁর আইনজীবী শিবশঙ্করবাবুর বিরুদ্ধেও মামলা করেন তিনি। চিকিৎসা সংক্রান্ত মামলাটি বাতিল হলেও পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা ক্রেতা আদালত ২০০৫ সালে অভিযুক্ত আইনজীবীকে ক্ষতিপূরণ বাবদ পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে নির্দেশ দেয়।

কিন্তু ওই ক্ষতিপূরণের টাকা না আসায় ত্রিপুরা রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে ফের মামলা করেন অনুপমবাবু। কিন্তু ভিন্ন রাজ্যের মামলা হওয়ায় ত্রিপুরা রাজ্য কমিশন মামলাটি বাতিল করে দেয়।

এর পরেও কিন্তু দমেননি অনুপমবাবু। আইনজীবীর গাফিলতির অভিযোগ এনে ২০০৭ সালে জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনে মামলা করেন তিনি। কমিশন জানায়, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী, এক জন মানুষের বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কমিশন সুপারিশ করে, এক্ষেত্রে অভিযোগকারী ব্যক্তিকে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে মামলা দায়ের করতে হবে।

ওই নির্দেশ মেনে ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতে শিবশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ফের মামলা করেন অনুপমবাবু। অভিযোগ, তাঁর বিরুদ্ধে মামলা শুরু হলেও আদালতে স্থগিতাদেশ নেন শিবশঙ্করবাবু। এর পর ফের জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশনে যান অনুপমবাবু। এক জন অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশন রাজ্য কমিশনকে দ্রুত মামলাটি নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়। অবশেষে ২০ নভেম্বর রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালত এক মাসের মধ্যে অভিযুক্ত আইনজীবী শিবশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়কে ক্ষতিপূরণ বাবদ এক লক্ষ টাকা দিতে নির্দেশ দেয়। রাজ্য ক্রেতা আদালতের বিচারক সমরেশ প্রসাদ চৌধুরী ও মৃদুলা রায় তাঁদের নির্দেশে জানিয়েছেন, এক জন অসুস্থ ব্যক্তির দায়ের করা মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে জাতীয় ক্রেতা সুরক্ষা কমিশন নির্দেশ দিলেও বিরোধী পক্ষ দিনের পর দিন মামলার শুনানিতে অনুপস্থিত ছিলেন। বিচারের প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করার জন্য বিভিন্ন কৌশলও তাঁরা অবলম্বন করেছেন। বিরোধী পক্ষ দিনের পর দিন শুনানিতে অনুপস্থিত থাকায় বাধ্যতামূলকভাবে এক সময় রাজ্য ক্রেতা আদালত সিদ্ধান্ত নেয়, অভিযোগকারীর একার বক্তব্য শুনেই মামলার নিষ্পত্তি করা হবে। এই সিদ্ধান্তের পরে বিরোধী পক্ষের আইনজীবী এই মামলায় অংশগ্রহণ করে।

রাজ্য ক্রেতা আদালত নির্দেশ দিলেও ক্ষতিপূরণের টাকা এখনও হাতে পাননি অনুপমবাবু। কেন ওই টাকা দেওয়া হয়নি জানতে চাইলে আইনজীবী শিবশঙ্কর বন্দোপাধ্যায় বলেন, ‘‘রাজ্য ক্রেতা সুরক্ষা আদালতের রায় পুরো একতরফা। এই রায়ের বিরুদ্ধে আমি জাতীয় কমিশনে মামলা করব।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন