বাবা সাজানো হয় দাদুকে

জন্মের ‘জাল’ শংসাপত্র পুলিশকে দিলেন ভাই

আর ইউ ফাদার অর গ্র্যান্ডফাদার? আধো অন্ধকারে দোতলা বারান্দার নীচ থেকে উড়ে এল প্রশ্নটা। লক্ষ্য যিনি, গত ২৪ ঘণ্টায় তাঁকে এই প্রথম দেখা গেল প্রকাশ্যে।

Advertisement

রাজীবাক্ষ রক্ষিত

গুয়াহাটি শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৫৮
Share:

স্কুলে শিনা।

আর ইউ ফাদার অর গ্র্যান্ডফাদার?

Advertisement

আধো অন্ধকারে দোতলা বারান্দার নীচ থেকে উড়ে এল প্রশ্নটা। লক্ষ্য যিনি, গত ২৪ ঘণ্টায় তাঁকে এই প্রথম দেখা গেল প্রকাশ্যে। তিনি উপেন্দ্রকুমার বরা। পিটার মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী ইন্দ্রাণীর বাবা আজ সন্ধে ৭টা-সাড়ে ৭টা নাগাদ এক বার বেরিয়ে এসেছিলেন গুয়াহাটির সুন্দরপুরের বাড়ির দোতলার বারান্দায়। বাড়ির সামনে দিনভর দাঁড়িয়ে থাকা সাংবাদিকদের ভিড়টা তখন একটু পাতলা। সেই জটলা থেকেই উড়ে আসে প্রশ্ন— আপনি বাবা না দাদু? অর্থাৎ নিহত শিনা বরা তাঁর কে হন?

বৃদ্ধকে আচমকা এই বেয়াড়া প্রশ্নের একটা সঙ্গত কারণ অবশ্য আছে। আজই প্রকাশ্যে এসেছে গুয়াহাটিতে রেজিস্ট্রি হওয়া শিনার জন্মের একটি শংসাপত্র। যেখানে দেখা যাচ্ছে, শিনার বাবার নামের জায়গায় লেখা রয়েছে উপেন্দ্রর নাম। আর মায়ের জায়গায় উপেন্দ্রর স্ত্রী দুর্গারানির নাম। যাঁরা কি না আসলে ইন্দ্রাণীর বাবা-মা! শিনার দাদু-দিদা।

Advertisement

কাজেই বরা-মুখোপাধ্যায় পরিবারের বংশলতিকা ঘিরে এখনও যথেষ্ট পরিমাণে ধোঁয়াশা। সেই প্রেক্ষিতেই উপেন্দ্রকে প্রশ্নটা করা। যার উত্তরে তিনি বলেন, ‘‘আই অ্যাম গ্র্যান্ডফাদার। হার ফাদার ইজ সিদ্ধার্থ দাস।’’ আবার প্রশ্ন— সেটা অন্য কেউ হতে পারেন কি? উপেন্দ্র জবাব দেন, ‘‘খতিয়ে দেখতে হবে।’’ ঠিক এর পরেই একজন বেরিয়ে তাঁকে টেনে ভিতরে নিয়ে যান।

শুরু হয়ে যায় নতুন জল্পনা। উপেন্দ্র ‘খতিয়ে দেখতে হবে’ বললেন কেন? তা হলে কি তাঁর নাতি-নাতনি— মিখাইল ও শিনার বংশপরিচয় নিয়ে আরও গোপন কোনও রহস্য চাপা পড়ে আছে?

দিসপুর থানায় ঢুকছেন মিখাইল বরা। —নিজস্ব চিত্র।

বস্তুত, শিনা হত্যা রহস্যে আজ সারা দিনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হল শিনার জন্মের দু’টি শংসাপত্র। দিসপুর থানায় আজ দু’টিই জমা দিয়েছেন শিনার ভাই মিখাইল। তাঁর দাবি, এর একটি আসল, একটি জাল। মিখাইলের বক্তব্য অনুযায়ী ‘আসল’ যেটি, সেটিতে শিনার বাবা-মা হিসেবে সিদ্ধার্থ দাস ও ইন্দ্রাণীর নাম রয়েছে। আর ‘জাল’ শংসাপত্রে নাম রয়েছে উপেন্দ্র-দুর্গারানির। সেটি তৈরি করিয়েছিলেন ইন্দ্রাণী। এই দ্বিতীয় শংসাপত্রটিই প্রকাশ করেছে পুলিশ।

সূত্র খুঁজতে যোগাযোগ করা হয়েছিল গুয়াহাটির খানাপাড়ার ডিজনিল্যান্ড স্কুলে। এখানকারই ছাত্রী ছিলেন শিনা। স্কুলের নাম অবশ্য এখন বদলেছে। কর্তৃপক্ষ জানালেন, স্কুলের ভোলবদলের সময়েই ছাত্রছাত্রীদের পুরনো সমস্ত নথিপত্র হারিয়ে গিয়েছে। তবে শিনার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সহপাঠিনীরা জানাচ্ছেন, অভিভাবকদের মিটিংয়ে উপেন্দ্রকেই আসতে দেখতেন তাঁরা। শিনা কখনও তাঁর বাবার কথা বলতেন না।

তেজপুরে ইন্দ্রাণীদের পৈতৃক বাড়িতে থাকেন তাঁর কাকা মানিক বরা। তিনি বলেন, ‘‘ইন্দ্রাণীর সঙ্গে শিলংয়ে সিদ্ধার্থের আলাপ। শুনেছিলাম ওদের বিয়ে হয়েছে। শিনা ও মিখাইল ওদের সন্তান। কিন্তু বিয়েতে কাউকে খবর দেওয়া হয়নি। ইন্দ্রাণী এখানে আসতও না। গত তিন বছর ইন্দ্রাণী ইংল্যান্ডে ছিল। শিনাও বিদেশে ছিল বলেই জানতাম।’’ মানিকবাবুর দাবি, তাঁর ভাইঝি যে পিটার মুখোপাধ্যায় নামে একজনকে বিয়ে করেছেন, শুধুমাত্র সেটুকুই তিনি জানতেন। পিটারের পেশাগত কোনও খবরাখবর তাঁর জানা ছিল না।

পুলিশের কাছে মিখাইল আজ দাবি করেন, পিটারের সঙ্গে বিয়ের বছরেই শিনার জন্মের ‘ভুয়ো’ শংসাপত্রটি তৈরি করান ইন্দ্রাণী। সেটা ২০০২-এর ঘটনা। বিয়ের খবর পেয়ে ইন্দ্রাণীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন উপেন্দ্র। তখনই ইন্দ্রাণী শর্ত দেন, মিখাইল-শিনাকে তাঁর ভাই-বোন হিসেবে পরিচয় দিতে হবে। তবেই তিনি তাঁদের ভার নেবেন। এই শংসাপত্রটি নথিভুক্ত হয়েছিল ২০০২-এর ৩০ এপ্রিল। সেখানে শিনার জন্ম তারিখ দেওয়া হয়েছে ১৯৮৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি। যদিও মিখাইলের দাবি, শিনার জন্মদিন আসলে ২৮ ফেব্রুয়ারি।

আজ বেলা আড়াইটে নাগাদ মুম্বইয়ের বান্দ্রা থানা থেকে এক ইনস্পেক্টর ও এক কনস্টেবল মিখাইলদের গুয়াহাটির বাড়িতে আসেন। পুলিশ সূত্রের খবর, বেশ কিছু পুরোনো ছবি এবং ই-মেল তাঁদের দেখান মিখাইল। পরে পুলিশের তলব পেয়ে বিকেল সাড়ে ৪টে নাগাদ মিখাইল নিজেই গাড়ি চালিয়ে বন্ধুদের নিয়ে দিসপুর থানায় যান। তখন থেকে সন্ধে সওয়া সাতটা অবধি মিখাইলের সঙ্গে কথা বলেন অফিসারেরা। পুলিশ সূত্রের বক্তব্য, তদন্তের স্বার্থে মিখাইলকে মুম্বই নিয়ে যাওয়া হতে পারে। তাঁকে ইন্দ্রাণীদের মুখোমুখি বসিয়ে জেরাও করা হতে পারে। পরে সাংবাদিকরা মিখাইলকে তাঁর বাবা-মার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘‘সময় মতো সব প্রকাশ পাবে। এখন আমি এ নিয়ে কিছু বলব না। পুলিশ ডাকলে আবার আসব। তবে বাড়িতে অসুস্থ দাদু-দিদাকে রেখে মুম্বই যাওয়া আমার পক্ষে সমস্যার।’’

সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

মিখাইলের দাবি, জ্ঞান হওয়ার পর ইন্দ্রাণীর সঙ্গে যখন তাঁর ও শিনার প্রথম দেখা হয়, তখন তিনি পিটারের স্ত্রী। কিন্তু সঞ্জীব খন্না নামে ইন্দ্রাণীর যে আরও এক জন স্বামী ছিলেন, সে কথা তাঁরা জানতেন না। সঞ্জীবের কথা টিভি দেখেই জেনেছেন তিনি। ইতিমধ্যে জানা গিয়েছে, সঞ্জীবের সঙ্গে বিয়ের পর বিধি নামে একটি মেয়ে হয় ইন্দ্রাণীর। মিখাইল বলছেন, বিধিকে তাঁরা পিটারের মেয়ে বলেই জানতেন। তদন্ত এগোনোর পরে অবশ্য দেখা যাচ্ছে, বিধিকে দত্তক নিয়েছিলেন পিটার। শিনাকে খুনের দায়ে সঞ্জীবও এখন পুলিশি হেফাজতে। মিখাইলের কথায়, ‘‘এখন তো দেখছি সঞ্জীব আর মা আমাকেও মেরে ফেলতে পারত! হয়তো সঞ্জীব গুয়াহাটির বাড়িটাও দখল করতে চাইছিল। দাদু-দিদিমাকেও ছাড়ত না ওরা। আমায় ও দাদু-দিদাকে কলকাতা নিয়ে যেতে মা বারবার চাপ দিচ্ছিল।’’

তবে পুলিশ সূত্রের বক্তব্য, মিখাইল সম্পর্কেও কিছু অপ্রীতিকর তথ্য মিলেছে। অভিযোগ, মিখাইল নেশা করতেন। মায়ের পাঠানো টাকায় দাদু-দিদার চিকিৎসা ঠিকমতো করাতেন না। মিখাইল নিজেও জানিয়েছেন, দাদু-দিদার দেখভাল নিয়ে মায়ের সঙ্গে তাঁর তর্কাতর্কি হয়েছিল। মা তাঁকে এক বার পুণের একটি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে পাঠিয়েছিলেন। গত কাল শিনার এক বান্ধবীও দাবি করেন, শিনা তাঁকে ফোন করে বলেছিলেন, তাঁকে রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে আটকে রাখার ব্যবস্থা করেছেন ইন্দ্রাণী। সেখানে তাঁর উপরে অত্যাচার হচ্ছে বলেও জানিয়েছিলেন। এই বান্ধবী এখন দেহরাদূনে। ঘটনাচক্রে সেখানেই থাকেন পিটারের প্রথম পক্ষের স্ত্রী শবনম ও ছেলে রাহুল।

বান্ধবীটি আজ জানান, রাহুলের সঙ্গে তাঁদের আলাপ হয়েছিল। রাহুল বলেছিলেন পরিবারে কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে। শীঘ্রই শিনার সঙ্গে তাঁর বিয়ে। যদিও রাহুল পুলিশকে জানিয়েছেন, শিনার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ইন্দ্রাণী, পিটার ও তাঁর মধ্যে প্রচণ্ড ঝামেলা হতো। পিটার মানতেই চাননি যে, শিনা আসলে ইন্দ্রাণীরই মেয়ে।

রাহুল জানান, শিনার সঙ্গে ছ’বছরের প্রেম ছিল তাঁর। প্রথম আলাপ এক পার্টিতে। তার পর মুম্বইয়ের একটি ফ্ল্যাটে তাঁরা একসঙ্গেই থাকতেন। শিনা যে দিন খুন হন, সেই ২০১২-র ২৪ এপ্রিল রাহুলই গাড়ি করে বান্দ্রায় নামিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন শিনাকে। তিনি জানতেন, শিনার মায়ের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন। কিন্তু এর পরেই উধাও হয়ে যান শিনা। বহু চেষ্টা করেও আর শিনার খোঁজ পাননি রাহুল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন