মুম্বই মনতাজ

প্রজাতন্ত্র ও বাগদেবীর উপাসনা

ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে।/ বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী, নমোহস্ততে।। নমো ভদ্রকালৌই নমোনিত্যং সরস্বতৈ নমো নমঃ। বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।। এষ সচন্দন পুষ্প-বিলম্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।। মহাভাসে বিদ্যেকমলোলোচনে। বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোস্তুতে।। বিশালাক্ষি বিদ্যার দেবি নমোস্তুতে।।…ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে।/ বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী, নমোহস্ততে।। নমো ভদ্রকালৌই নমোনিত্যং সরস্বতৈ নমো নমঃ। বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।। এষ সচন্দন পুষ্প-বিলম্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।। মহাভাসে বিদ্যেকমলোলোচনে। বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোস্তুতে।। বিশালাক্ষি বিদ্যার দেবি নমোস্তুতে।।…

Advertisement

মিলন মুখোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০১৬ ০০:০৬
Share:

শেষ রাতের ঠান্ডা বাতাসের আমেজে চোখ জোড়া আর খুলে রাখতে পারি না। তবু ভয়ে এবং আশায় চোখ টানটান করে আলপনা এঁকে যেতে হয়। ভয় পরীক্ষায় ফেল করতে পারি। আশা ভাল নম্বর পাব। আলপনা শেষ হয়। অন্ধকার ফিকে হয়ে আসে বাইরে। কলজেতে একটু ধোঁয়ার উষ্ণতা দিয়ে চাঙ্গা হয়ে নিতে হলঘর থেকে বাইরে খোলামেলা বাতাসে এসে দাঁড়াই খোলা উঠোনে দাঁড়িয়ে ক্লান্ত চোখে আকাশের আঙিনায় চেয়ে দেখি রংয়ের খেলা সারা আকাশ জুড়ে। ফিকে নীলকে আস্তে আস্তে রাঙিয়ে দিচ্ছে লাল, গেরুয়া এবং বাসন্তি রংয়ের ছটা। সূর্য উঠছেন বুঝি বীণাবিনীর সৌজন্যে। অন্ধকার দূর করে দিচ্ছেন তিনি জ্ঞান-বুদ্ধি ও শিক্ষা-দীক্ষা আলোর উদ্ভাসে, উৎসবে। মনে মনে শুনি, সকালের ঘুম ঘুম চোখে শুনি দু’হাতের অঞ্জলি মেলে শুনি।

Advertisement

ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে।

Advertisement

বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী, নমোহস্ততে।।

নমো ভদ্রকালৌই নমোনিত্যং সরস্বতৈ নমো নমঃ।

বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।। এষ সচন্দন পুষ্প-বিলম্ব পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।। মহাভাসে বিদ্যেকমলোলোচনে। বিশালাক্ষি বিদ্যাং দেহি নমোস্তুতে।।

বিশালাক্ষি বিদ্যার দেবি নমোস্তুতে।।….

বছরের পর বছরের পর বছরের পর বছর ধরে শুনে আসছি মন্ত্র। মন্ত্র-তন্ত্রর গায়ে গায়ে এল গণতন্ত্র, স্বাধীনতা। আরও তন্ত্র ‘প্রজাতন্ত্র’। সেই ‘প্রজাতন্ত্র’ও এখ বালাই পঁইষট্টি উত্তীর্ণ হয়ে ‘সিনিয়ার সিটিজেন’ হল।

অথচ ‘‘প্রজাবর্গের প্রতিনিধি-কর্তৃক পরিচালিত স্বাধীন রাষ্ট্র’’ ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত আমাদের দেশ অ্যাদ্দিন ধরে কদ্দুর পিছিয়েছে বলা মুশকিল, তবে, খুব অগ্রগতি যে হয়েছে, তার নমুনা কই? বাগানের ঝোঁপঝাড় গাছপালা শুকিয়ে হয়তো যায়নি। তবে, নতুন মালির দলবল সে বাগানে কত ফুল বা কত ফল ফলিয়েছেন সে বিষয়ে সন্দেহর অবকাশ আছে, বইকি!

কেন আমাদের ‘ইনফর্মেশন টেকনলজি’র দৌলতে দেশ কী রকম সারা বিশ্বের ‘আণবিক কেলাবের’ মুষ্টিমেয় সদস্যদের একজন হল। গতি বেড়েছে বইকি। নইলে চাঁদে গিয়ে ‘বাস্তুশাস্ত্র’ এবং ‘ফেং শুই’ মতে ভিটেমাটি কিনে ঘর বানাবার পরিকল্পনা হু হু করে কী রকম এগোচ্ছে দেখছেন না।’

দেখছি বটে! সেই দেখেই তো কণ্টকিত হয়ে আছি। দেশের মাটিতেই এই দশা। সত্যিই যদি এবং কখনও চাঁদে পৌঁছে যাই তো সেখানকার জমি নিয়েও লাঠালাঠি, ধম্মের দোহাই দিয়ে রাজনৈতিক চুলোচুলিতে দিদিমা-ঠাকুমাদের চাঁদমামার প্রাণ যে ওষ্ঠাগত হবে—সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

আর ‘ইনফর্মেশন টেকনোলজি’? কতিপয় শহরের ঘরে ঘরে ওই ‘ব্রাহ্মাণ্ড-বক্সে শোভা পাচ্ছে ঠিকই! গুগল, গুলে খবর, ইতিহাস, ভূগোল, ব্যুৎপত্তির হদিসও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু দেশ জুড়ে তাবৎ খেত খামার যেমন বন্যায় ভেসে ফসল ধ্বংস হয়ে যেত এখনও যাচ্ছে। খরায় ফুটিফাটা জমিতে দাঁড়িয়ে চাতকের মতো ঊর্ধ্ব মুখে হাপিত্যেশ করছে গ্রামবাসী জলের জন্যে। বৃষ্টির জন্যে। আগের মতোই। সুনামী আসার আগাম খবর, কোনও ‘ইনফর্মেশন’ই দিয়ে উঠতে পারছে না ‘টেকনোলজি’। স্রেফ দশটি সন্ত্রাসবাদী ছোকরা নৌকো চড়ে এসে আগুন-রক্ত ছড়িয়ে গেল সারা মুম্বই শহরে। আর আমরা সব কী করছি? না, প্রাণপণ দৌড়চ্ছি। মুম্বই ম্যারাথন!! কী জন্যে? না, চ্যারিটি? কীসের চ্যারিটি, কার জন্যে চ্যারিটি, তার হদিস শতকরা নব্বই জনই জানে না। প্রজাতন্ত্র দিবস ছুটির দিন। আড্ডা মারো, পাড়ার গলিতে ফুটবল, ক্রিকেট খেলো আর ঘরে ঢুকে বোকাবাক্সে দ্যাখো—কী ঝলমলে পোশাক আহা, নয়ন জুড়োয়। লেফট রাইট করে সব সৈন্য সামন্ত নিজ নিজ অস্ত্র-শস্ত্র দ্যাখাচ্ছে আহা কী শক্তি! নানান রাজ্যের ঐতিহ্যবাহী সনাতন বস্ত্র সম্ভার রাজধানীর রোদ্দুরে চোখ ঝলসে যায় মরি-মারি!

‘বালাই পঁইষট্টি প্রজাতন্ত্র ‘ইজ ইকোয়াল টু’ রাতের রেলগাড়ি। দীর্ঘ সফরে বিভিন্ন নৈরাজ্য পেরিয়ে, বাঁধা লাইন ধরে চলেছে। রেলগাড়ির বিশেষত্ব হল এর ইঞ্জিন ‘জিডিট্যাল টেকনোলজি’তে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। পেছনে জোড়া লাগানো কামরাগুলি সেই সনাতন লজঝরে ষাট-বাষট্টি বছরের প্রাচীন। ইঞ্জিনের সঙ্গে জোড়া দু’চার খানা কামরা ‘জিডিট্যালে’র কোমর আঁকড়ে ‘পড়ি কী মরি’ করে টালমাটাল ছুটছে। তার পরের সব কটি হয় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে বা হল বলে। কয়েকটি আলগা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে যাত্রা শুরুতেই। দু’তার গজও এগোয়নি! আমরা ‘হিন্দুস্তানকা শাহী অওলাদ’ নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছি। কেউ মুম্বইয়ের কেউ কলকাতার বা কেউ বিহারের যাত্রী।

রেলগাড়ির গতি (না কি প্রগতি!) এবং দুলুনিতে চাদর মুড়ি দিয়ে গভীর ঘুমে কাদা। কয়েক মুহূর্তের জন্যে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে যেমন চট করে মালুম হয় না—গাড়ি দাঁড়িয়ে গেছে না একই গতিতে ছুটছে? না, কি পেছুচ্ছে! নিদ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় মাথা তুলে পরখ করার গরজও তেমন নেই। কে আবার এই অন্ধকারে উঠবে।’ সব্বাই অভ্যাসের অঘোর ঘুমে, আরামে কাতর। ঘুমিয়ে পড় বাছা। কী হবে দেখে? চললে চলছে। বাঙ্কে যত যাত্রি ঘুমোচ্ছে তাদের সঙ্গে চলছি না। না চললে নেই। উঠে হবে টা কি? রেলগাড়ি তো আর ঠেলে নিয়ে যেতে পারব না। বরং ততক্ষণ ঘুমিয়ে নিই! ব্যাস। গপ্পো খতম, গতি-প্রগতি হজম।

আমাদের দেশের জাতীয় পক্ষী এমন যে যার পাখনায় জোর নেই। কোনও রকমে উড়াল দিয়ে ফেলল হয়তো বাধ্য হয়ে, বার পাঁচ-ছয় দুর্বল ডানা ঝাপটে, হেদিয়ে, লতলতিয়ে গেল পড়ে মাটিতে মুখ থুবড়ে। বাহারি বটে, তবে অকেজো পাখনা। একেবারে খাপে খাপে।

প্রজাতন্ত্র ও বাগদেবীর উপাসনা প্রসঙ্গে মনে পড়ে। এতকাল সুন্দরবনের ‘রয়েল বেঙ্গল টাইগার’ ছিল ভারতের জাতীয় পশু। এ বার বদলে যাচ্ছে। বদলে কী বা কে হবে সেটি নির্ভর করবে আপনার ওপর। তিনটির মধ্যে একটি পশুকে বেছে নিন। হাতি, দিশি বাঁদর অথবা বুনো মোষ। ভাবুন, মহাবলবান দক্ষিণরায়ের পদক বা মান-সম্মান ছিনিয়ে নিয়ে শেষপর্যন্ত বাঁদরের গলায় ঝুলিয়ে দেবার পরিকল্পনা চলছে।

হতেই পারে। যে হারে ডোরাকাটা কেঁদো বাংলার বাঘ বাহাদুর দিনকে দিন সংখ্যায় কমে যাচ্ছে, তাতে আমাদের জাতীয় পশু কিছুদিনের মধ্যে সম্পূর্ণ বা বিলুপ্ত হবার আশঙ্কা তো উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ফলে, সচেতন ভারতবাসী, বিশেষ করে কতিপয় মুম্বই নিবাসীর ‘দেশপ্রেম’ একেবারে যারপরনাই উথলে উঠছে। সহসা উত্তেষ্ঠিত ও জাগ্রত সংরক্ষণ সংস্থাটি ‘Sprouts’ নামে পরিচিত। ‘জাতীয় পশু’ বদলের জন্যে সম্প্রতি এরা একটি প্রচার অভিযান শুরু করে দিয়েছেন। জীববিদ্যা-বিশারদ ও ‘স্প্রাউটসে’র পরিচালক আনন্দ পেন্ডারকরমশাই ব্যক্ত করলেন,

সমগ্র দেশে বাঘের সমখ্যা অ্যাতো দ্রুত নেমে যাচ্ছে যে কয়েক বছরের মধ্যেই এই প্রাণী পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যাবে।’’

ফলে ইন্টারনেট মাধ্যমে ‘অন-লাইনে’ এই সংস্থা দিকে দিগন্তে প্রচার অভিযান শুরু করেছেন এবং উক্ত হাতি-বুনোমোষ ও বাঁদরের মধ্যে কোনটি আপনার পছন্দ জানিয়ে পত্রপাঠ উত্তর দিন। ‘www.sproutsenttrst.org’ সাইট দেখে নিতে পারেন। এই উদ্যোগের সঙ্গে ব্যবসায়িক সংস্থা মুদ্রা কমিউনিকেশন যুক্ত হয়েছে।

বাঘ-বিশেষজ্ঞ বন্যজন্তু গবেষক ডঃ আর এস চুঁড়াওয়াত সব শুনে টুনে মাথা নেড়ে সায় দিয়ে ব্যক্ত করেছেন বাহ। এ তো ইন্টারেস্টিং ক্যাম্পেন। ব্যাঙ্গত্মক পথে হুল ফুটিয়ে সরকারকে জানান দেওয়া, যে তরীর ডুবুডুবু দশা এখনও সামাল দাও, নইলে ডুবেই যাবে।’’

সুতরাং সচেতন বাঙালি, তথা দেশবাসী ‘প্রজাতন্ত্র দিবসে’ স্থির-প্রতিজ্ঞ হয়ে, জাতির মান-সম্মান বাঁচাতে বাঘবাবাজীবনের ল্যাজ আঁকড়ে পড়ে থাকুন—প্রাণ যায় যাক, মানুষ প্রাণীর জীবনের মানসম্মান বা মূল্যই বা কতটুকু জনসংখ্যাও তো কমছে না, বরং বাড়ছে। সুতরাং সুতিথিও অ্যাতো সব বাধা-বিপত্তি, ক্ষয়ক্ষতি, ভয় ভ্রান্তির মধ্যে বেশ হেসে খেলে শুভ্র বসনে এসে হাজির হচ্ছেন আমাদের হা-ক্লান্ত জীবনে। শ্রীপঞ্চমী। সেই বাগদেবীর অনুগ্রহেই তো ‘মনতাজ মহল’ সাজাতে পারছি। তাঁরই আশীর্বাদে আপনারাও পুষ্ট হয়ে, গড়গড়িয়ে পড়ে চলেছেন শব্দের পর শব্দ, ছত্রের পর ছত্র। সুতরাং তাঁকে ছাড়া যে গতি নেই। প্রগতি তো দূরের কথা। এই মনতাজের শুরুতেই যে ব্রহ্মাণ্ড বাক্স বা ইন্টারনেটের কথা বলছিলুম, সেখান থেকেও ঠিকঠাক ‘ইনফর্মেশন’ জোটানোর জন্যেও তো সরস্বতির কৃপাদৃষ্টি প্রয়োজন।

অক্ষর জ্ঞানও নেই এমন মানুষ এখনও এ দেশে রয়েছেন শতকরা প্রায় চল্লিশ জন। যদিও একেবারে শিকড় ধরে শুরু করার চেষ্টা চলছে। তথাপি, শিশু-শিক্ষার অগ্রগতি এখনও তেমন জোরদার নয়। গ্রামেগঞ্জে পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শতকরা প্রায় আশি জনই আজও ‘স্বাধীনতা প্রজাতন্ত্র’ ইত্যাদি গাল ভরা বিশেষণের ষাট-পঁইষট্টি বছর পেরুলেও ১০ থেকে ৯০ অবধি চিনতে পারে না। তবে হ্যাঁ। স্লেট বগলে আগের থেকে অনেক বেশি কচি-কাঁচাদের বিদ্যালয় যাত্রাও তো খানিকটা ‘প্রগতি’র চিহ্ন বইকি!

বালক বয়েসে শোনা ছড়াটির রকমফেরে অনেক তফাত।

‘‘লেখাপড়া করে যে গাড়িঘোড়া চড়ে সে।’’ এবং

‘‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি চাপা পড়ে সে।’’

সমগ্র দেশের অবুঝ সবুজদের প্রথমটিই বিশ্বাস করিয়ে দিতে হবে। সেই আশায় প্রার্থনা ফি বছর—

জয় জয় দেবী চরাচরসারে কুচযুগশোভিত মুক্তাহারে!

বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্ততে!!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন