দাগিদের মন্ত্রী করা না করার বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ‘শুভবুদ্ধির’ উপরেই ছেড়ে দিল সর্বোচ্চ আদালত।
জনস্বার্থ মামলাটির আর্জি ছিল মন্ত্রিসভা থেকে ‘দাগি’ মন্ত্রীদের অপসারণ। দশ বছর আগে, ইউপিএ জমানায় সেই মামলা দায়ের হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে। এক দশক ধরে শুনানির পর আজ রায় দিয়েছে প্রধান বিচারপতি আর এম লোঢার নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির সংবিধানিক বেঞ্চ। ফৌজদারি মামলা রয়েছে এমন মন্ত্রীদের মন্ত্রিত্ব খারিজ করতে সুপ্রিম কোর্ট রাজি হয়নি ঠিকই। কিন্তু এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এক্তিয়ার প্রধানমন্ত্রী এবং মুখ্যমন্ত্রীদের শুভবুদ্ধির ওপর ছেড়ে দিয়ে কোর্ট যথেষ্ট পরিমাণে নৈতিক চাপ বাড়িয়েছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিচারপতিরা আজ জানান, সংবিধানের ৭৫ (১) ধারা অনুযায়ী মন্ত্রিসভা গঠনের এক্তিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর। কিন্তু দুর্নীতি দেশের শত্রু। সংবিধানের রক্ষক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে এটাই প্রত্যাশিত যে, তিনি এমন কাউকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ করবেন না যাঁর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলায় চার্জশিট রয়েছে, অথবা গুরুতর অপরাধ বা দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। রায় দিতে গিয়ে তাঁরা বলেন, “সংবিধানে প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীদের উপরে অগাধ আস্থা রাখা হয়েছে। এটাই আশা করা যায় যে, তাঁরা সেই দায়িত্বশীলতা ও সাংবিধানিক নৈতিকতা মেনে কাজ করবেন। আদালত এর বেশি আর কিছু বলতে চাইছে না।”
বস্তুত, এই মামলায় কেন্দ্রের তরফেই বলা হয়েছিল যে, মন্ত্রীদের নিয়োগের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর অধিকারের মধ্যে পড়ে। সুতরাং কারও মন্ত্রিত্ব খারিজ করা হলে তা প্রধানমন্ত্রীর সাংবিধানিক এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপের সামিল হবে। সরকারের এই যুক্তিই গ্রহণ করে আজ আবেদনকারীর আর্জি খারিজ করে দেয় আদালত। সে দিক থেকে আপাত ভাবে মনে হতে পারে যে, প্রশাসনের সঙ্গে কোনও সংঘাতে গেল না বিচারব্যবস্থা। কিন্তু তা না করলেও সর্বোচ্চ আদালত রায় ঘোষণার সময় যা বলেছে, তা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, এটি সুপ্রিম কোর্টের কোনও সাধারণ পর্যবেক্ষণ নয়। এ বার থেকে সাংবিধানিক বেঞ্চের এই মতকে অস্ত্র করেই বিভিন্ন রাজ্য ও কেন্দ্রে শাসক দলকে বেকায়দায় ফেলতে চাইবেন বিরোধীরা। ইতিমধ্যে তাঁরা ময়দানে নেমেও পড়েছেন।
নরেন্দ্র মোদীর মন্ত্রিসভাতেই এই মুহূর্তে ১৪ জন মন্ত্রী রয়েছেন যাঁদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা চলছে। কেন্দ্রীয় জলসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী উমা ভারতীর বিরুদ্ধে খুনের মামলা-সহ মোট ১৩টি ফৌজদারি মামলা ঝুলছে। কেন্দ্রীয় সার ও রসায়ন প্রতিমন্ত্রী নিহালচাঁদের বিরুদ্ধে সম্প্রতি একটি ধর্ষণের মামলা দায়ের হয়েছে। স্বাভাবিক ভাবেই আজকের রায় তাঁদের পক্ষে অস্বস্তিকর। যদিও প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় বা কেন্দ্রের তরফে আজ এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন উমা ভারতীও।
রায় প্রসঙ্গে কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র অজয় মাকেন বলেন, মোদী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর মন্ত্রিসভায় বাবুভাই বোকারিয়া বা মায়া কোডনানির মতো মন্ত্রীরা স্বমহিমায় থেকেছেন। তাই নৈতিকতার প্রশ্নে মোদীর উপরে বিরোধীদের আস্থা নেই। কিন্তু আদালতের এই রায়ের পর কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্তদের অপসারণ করতে হবে বলে দাবি তুলেছেন মাকেন। তখন অবশ্য এ প্রশ্নও ওঠে যে, কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলিতেও কি এই নীতি কার্যকর করবে হাইকম্যান্ড? জবাবে মাকেন বলেন, “সেটাই প্রত্যাশিত।”
ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত আইনসভার সদস্যদের সম্পর্কে গত বছর একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় ঘোষণা করেছিল সুপ্রিম কোর্ট। সেই মাইলফলক রায়ে বলা হয়েছিল, আইনসভার কোনও সদস্যের দু’বছরের বেশি সশ্রম কারাদণ্ড হলে তৎক্ষণাৎ তাঁর সদস্যপদ খারিজ হয়ে যাবে। ওই রায়ের জেরেই লোকসভায় লালু প্রসাদের সদস্যপদ খারিজ হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত মন্ত্রীদের মন্ত্রিসভায় রাখা নিয়েও সুপ্রিম কোর্টের উপর্যুপরি সমালোচনার মুখে পড়েছিল মনমোহন সিংহের সরকার। আর সেই সব পর্যবেক্ষণকে রাজনৈতিক হাতিয়ার করেছিল বিজেপি।
মজার কথা, ইউপিএ জমানায় আদালত যখন এ ধরনের পর্যবেক্ষণ শোনাত তখন অনেকে মনে করতেন, কেন্দ্রে দুর্বল সরকার থাকার জন্যই আদালত এত সক্রিয়। লোকসভা ভোটে বিজেপি বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতা দখলের পর তাঁরা মনে করেছিলেন, সুপ্রিম কোর্ট হয়তো এ বার আর হঠাৎ করে কোনও পর্যবেক্ষণ দেবে না, প্রশাসনের সঙ্গে সংঘাতেও যাবে না। কিন্তু আজকের রায় দেখে কিছুটা হলেও মত বদলাচ্ছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, সরাসরি প্রশাসনের অধিকারে সর্বোচ্চ আদালত হয়তো হস্তক্ষেপ করেনি, কিন্তু সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ও আকাঙ্ক্ষার কথা মাথায় রেখে যে রায় আজ দিয়েছে, তাতে নিঃসন্দেহে চাপে পড়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার।