পাকিস্তান যাবেন মোদী, যৌথ বিবৃতিতে ভারতের উদ্বেগকে গুরুত্ব

হুমকি আর পাল্টা হুমকি চলছিল গত প্রায় এক বছর ধরে। ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সেই টানাপড়েনে আজ রাশ টানলেন নরেন্দ্র মোদী এবং নওয়াজ শরিফ। রাশিয়ার উফা শহরে মুখোমুখি আলোচনায় বসে। সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর সম্মেলনের ফাঁকে চা-সহযোগে ঘণ্টাখানেকের একান্ত বৈঠকের নির্যাস: সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে আগামী বছরে পাকিস্তান যাবেন নরেন্দ্র মোদী।

Advertisement

অগ্নি রায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৫ ০০:০৯
Share:

অবশেষে আলোচনা। শরিফ ও মোদী। রাশিয়ার উফায়। ছবি: পিটিআই।

আর পাল্টা হুমকি চলছিল গত প্রায় এক বছর ধরে। ভারত-পাক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সেই টানাপড়েনে আজ রাশ টানলেন নরেন্দ্র মোদী এবং নওয়াজ শরিফ। রাশিয়ার উফা শহরে মুখোমুখি আলোচনায় বসে।

Advertisement

সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও)-এর সম্মেলনের ফাঁকে চা-সহযোগে ঘণ্টাখানেকের একান্ত বৈঠকের নির্যাস: সার্ক সম্মেলন উপলক্ষে আগামী বছরে পাকিস্তান যাবেন নরেন্দ্র মোদী। তার আগে নয়াদিল্লিতে সন্ত্রাস নিয়ে বৈঠকে বসবেন দু’দেশের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা। সঙ্গে রইল ২৬/১১-র হামলার বিচার দ্রুত শেষ করার পথ খোঁজার যৌথ অঙ্গীকারও।

গত রাতেই বারামুলায় সংঘর্ষ বিরতি ভেঙে পাক বাহিনীর চালানো গুলিতে মারা গিয়েছেন বিএসএফের এক জওয়ান। তার পরেও আজ শরিফের সঙ্গে মোদীর এমন ‘হার্দিক’ বৈঠকে খানিকটা অবাক কূটনৈতিক মহলের একাংশ। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর গরম সুর আচমকা কেন নরম হল, তাই নিয়ে জল্পনা যেমন দিল্লিতে, তেমন ইসলামাবাদেও। বিজেপি যখন বিরোধী আসনে, তখন এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগের তীব্র সমালোচনা করেছে তারা। বিদ্ধ করেছে মনমোহন সিংহকে। ক্ষমতায় আসার পরেও মোটের উপর সেই সুর বজায় ছিল। মোদীর শপথে শরিফ এসেছিলেন বটে। গত বছর মে মাসে দিল্লিতে দু’জনের বৈঠকও হয়েছিল। কিন্তু সেটাই শেষ। তার পর যতই সময় গড়িয়েছে, ততই পাকিস্তান সম্পর্কে কড়া হয়েছে মোদী সরকারের মনোভাব। কাশ্মীরের বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে পাক হাইকমিশনারের বৈঠকের জেরে ভেস্তে গিয়েছে দু’দেশের বিদেশসচিব পর্যায়ের বৈঠক। বাংলাদেশে গিয়ে মুক্তি-যুদ্ধ নিয়ে মোদীর মন্তব্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পাকিস্তান। ভারতীয় সেনা মায়ানমারে ঢুকে জঙ্গি নিধনের পরে ‘এটা অন্য প্রতিবেশীদের প্রতিও বার্তা’ বলে পরোক্ষে পাকিস্তানকে হুমকি দিয়েছেন মোদী সরকারের মন্ত্রীরা। পাক নেতারাও জবাব দিয়েছেন চড়া গলায়। পরমাণু শক্তিধর দুই দেশের এহেন চাপানউতোরে উদ্বেগ ছড়িয়েছিল গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়।

Advertisement

এমন একটা তপ্ত বাতাবরণে দুই নেতার বৈঠক এবং তার পর দু’দেশের বিদেশসচিবের যৌথ বিবৃতির ছত্রে ছত্রে সৌহার্দ্যের বার্তা তাই বিস্ময় ছড়িয়েছে স্বাভাবিক ভাবেই। ভারতের কূটনীতিকদের একাংশ অবশ্য জানাচ্ছেন, পরিস্থিতি বদলাচ্ছিল তলায় তলায়। সূত্রের দাবি, রমজানের শুরুতে মোদী যখন ফোনে নওয়াজকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন, কার্য‌ত তখনই তৈরি হয়ে গিয়েছিল রাশিয়ার আজকের বৈঠকের নীল নকশা।

আজ ভারত-পাক দু’পক্ষই দক্ষিণ এশিয়া থেকে সন্ত্রাসকে উপড়ে ফেলার ডাক দিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গোটা অঞ্চলে ‘শান্তি বজায় রাখা’ এবং ‘উন্নয়ন এগিয়ে নিয়ে যাওয়ায়’ দু’দেশের ‘যৌথ দায়িত্ব’ রয়েছে। নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের বৈঠকের পর দু’দেশের ডিজি (মিলিটারি অপারেশনস) এবং সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ডিজি’-রাও বৈঠকে বসবেন।

২৬/১১-র প্রধান চক্রী বলে অভিযুক্ত জাকিউর রহমান লকভি বেশ কিছু দিন আগেই জামিন পেয়েছে পাকিস্তানের কোর্টে। তাকে নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জ পর্যন্ত গড়িয়েছে ভারত-পাক দড়ি-টানাটানি। অনেকের মতে, আজকের বিবৃতিতে সরাসরি লকভির নাম রাখা না-গেলেও মুম্বই সন্ত্রাস নিয়ে পাকিস্তানের অঙ্গীকার যে আদায় করা গিয়েছে, সেটাই দিল্লির বড় সাফল্য।

ভারত দীর্ঘ দিন ধরে ২৬/১১-র অভিযুক্তদের কণ্ঠস্বরের নমুনা চাইছে। যাতে এই হামলা চলাকালীন জঙ্গিদের যারা যোগাযোগ রাখছিল, তাদের রেকর্ড করা কণ্ঠস্বরের সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখা যায়। পাকিস্তান আইনি প্রসঙ্গ তুলে এত দিন সেই দাবি মানেনি। ভারতের কূটনীতিকেরা বলছেন, মুম্বই সন্ত্রাসের বিচার দ্রুত শেষ করার পথ খুঁজতে রাজি হওয়ার পাশাপাশি এ বার কণ্ঠস্বরের নমুনা দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে পাকিস্তান।

শেষ পর্যন্ত যৌথ বিবৃতিতে দেওয়া প্রতিশ্রুতি ইসলামাবাদ মানবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তারা। নর্থ ব্লক সূত্র বলছে, দু’দেশের নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের বৈঠকে দাবি জানানো হবে, লকভির পাশাপাশি দাউদ ইব্রাহিম, লস্কর-ই-তইবার প্রধান হাফিজ সইদ-দেরও দিল্লির হাতে তুলে দেওয়া হোক। তবে সে দাবি আদায় যে দুঃসাধ্য, দিল্লি তা জানে। রাজধানীর কর্তাদের একাংশের কথায়, মুখোমুখি আলোচনার প্রয়োজনীয়তা বরাবর মেনে এসে ছেন মোদী ও শরিফ। সঙ্ঘ পরিবারও পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনার বিপক্ষে ছিল না। কিন্তু তাদের দাবি ছিল, আলোচনা হলে ইসলামাবাদের সঙ্গে কড়া দর-কষাকষির পথে হাঁটতে হবে। সেই মতো আজকের বৈঠকে সৌজন্যের আবহেও ভারতের উদ্বেগের কথা বিস্তারিত ভাবে তুলে ধরেছেন মোদী। কিন্তু সমস্যা হল, শরিফ ভারতের পাশে থাকার বার্তা দিলেও পাক সেনাবাহিনী, আইএসআই এবং ভারত-বিরোধী মৌলবাদী শক্তিগুলি এই শান্তি প্রক্রিয়া বানচাল করতে তৎপর হবেই। এক কর্তার কথায়, ‘‘এর আগেও এ ধরনের প্রতিশ্রুতি এসেছে। এক দিকে শান্তির উদ্দেশ্যে লাহোরে বাসযাত্রা হচ্ছে। আর উল্টোদিকে কার্গিলে তখন পাক সেনা অনুপ্রবেশ করছে। সুতরাং না আঁচালে বিশ্বাস নেই।’’

আজকের বৈঠকের নিরিখে কূটনীতিবিদদের অনেকে বলছেন, একটি ঐতিহাসিক মুহূর্তেই ভারত-পাক সম্পর্কে নয়া মোড় এল। আজই এসসিও-র সদস্য হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। চিন এবং রাশিয়ার নেতৃত্বে গঠিত এই বহুপাক্ষিক মঞ্চটিতে দু’দেশের এক সঙ্গে জায়গা পাওয়াটা গোটা অঞ্চলের ভূকৌশলগত রাজনীতিকেও বাড়তি মাত্রা দিল। আজ মোদী-শরিফের বৈঠককে দ্রুত স্বাগত জানিয়েছে ওয়াশিংটন। মার্কিন বিদেশ দফতরের মুখপাত্র জন কার্বি জানান, ‘‘আমরা চাই উত্তেজনা কমুক। দু’দেশ নিজেদের মধ্যে বিষয়গুলি নিজেরা মেটাক।’’ রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব বান কি মুন বলেন, ভারত-পাক সম্পর্কের উন্নতি গোটা অঞ্চলের শান্তির পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন