পাশাপাশি। উত্তর-পূর্ব সফরে আসা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে স্বাগত জানাতে গুয়াহাটি বিমানন্দরে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা। শুক্রবার পিটিআইয়ের ছবি।
মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমাকে সঙ্গে নিয়ে মিজোরামের স্টলে দাঁড়ালেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। উত্তেজনা সামলে স্টলের তিন কন্যা মোদীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে সৌজন্য বিনিময় সারলেন। তিনি পা বাড়ানোর আগেই একজনের হাতে উঠে এল সেলফি স্টিক। মোদীর সেলফি-প্রীতির কথা তাঁরা শুনেছিলেন। এসপিজি আপত্তি জানানোর আগেই প্রধানমন্ত্রীকে সেলফির আবদার জানালেন তাঁরা। সানন্দে রাজি তিনিও। হাসিমুখে তিন কন্যার সঙ্গে ফ্রেমবন্দি হয়ে এগিয়ে চললেন সিকিমের স্টলের দিকে।
শিলঙে উত্তর-পূর্ব পরিষদের সভায় বা জনসভাতেও মোবাইল, অ্যাপ, অ্যান্ড্রয়েড, মিসড কল, ডিজিটাল ইন্ডিয়া-র হাতিয়ারেই শিলংবাসীর মন জিতলেন মোদী। সেই সঙ্গে ছিল তিনটি ট্রেন, ফুটবল স্টেডিয়াম, ডপলার রেডারের উদ্বোধন। শপথ গ্রহণের দু’বছরের মাথায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই প্রথম দু’দিনের সফরে মেঘালয়ে এলেন মোদী। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে বিশেষ সাহায্যপাপ্ত রাজ্যের তালিকা থেকে বাদ দেওয়া ও কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ৯০:১০ অনুপাতে সাহায্য বন্ধ করার সিদ্ধান্তে উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি ক্ষুব্ধ ছিল। অসমের তত্কালীন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈয়ের নেতৃত্বে তা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরবারও করেন মুখ্যমন্ত্রীরা। এ বার অসমে ক্ষমতা দখলের সাত দিনের মধ্যেই অসমের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালকে পাশে নিয়ে মোদী উত্তর-পূর্ব পরিষদের বৈঠকে ঘোষণা করলেন, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিকে আগের মতো ৯০:১০ অনুপাতেই সাহায্য দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। তিনি জানান, উত্তর-পূর্বের মুখ্যমন্ত্রীদের আবেদন মেনে নিয়ে কেন্দ্র আগের মতোই ‘কোর’ কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ৯০ শতাংশ ও ‘নন-কোর’ কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ৮০ শতাংশ অর্থসাহায্য দেওয়ার নীতিই চালিয়ে যাবে।
আজ সকালে উত্তর-পূর্ব পরিষদের বৈঠকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী জিতেন্দ্র সিংহ জানান, উত্তর-পূর্বে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বাড়াতে বিভিন্ন পদক্ষেপ করেছে মন্ত্রক। খোলা হবে নতুন এফএম চ্যানেল। উত্তর-পূর্বের ছাত্রছাত্রীদের জন্য দিল্লিতে গড়া হয়েছে ছাত্রাবাস। জৈব চাষে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মন্ত্রক কর্মসংস্থান, দক্ষতাবৃদ্ধিতে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। জোর দেওয়া হচ্ছে ব্রডগেজ সম্প্রসারণ, পড়শি দেশগুলির মধ্য দিয়ে সড়ক সম্প্রসারণ, ব্রডব্যান্ড আনা, ক্রীড়া পরিকাঠামো বিকাশ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনে।
উত্তর-পূর্ব পরিষদ ও পোলো গ্রাউন্ডের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী জানান: রেল, সড়ক, টেলিকম, বিদ্যুৎ, জলপথের মাধ্যমে উত্তর-পূর্বকে ভারত তথা গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত করাই কেন্দ্রের লক্ষ্য। তাই উত্তর-পূর্বের জন্য কেন্দ্রীয় বাজেটে ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অসমে ব্রহ্মপুত্র গ্যাস ক্র্যাকার ও নুমালিগড় ওয়্যাক্স ইউনিটের কথা উল্লেখ করে মোদী জানান, ‘‘এই ধরণের বড় প্রকল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ বহুগুণ বাড়বে ঠিক। কিন্তু প্রকল্পগুলি শেষ করতে অনেক সময় লেগেছে। বেড়েছে খরচের পরিমাণ।’’ তিনি জানান, কেন্দ্রের নীতি হবে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অতিরিক্ত অর্থ খরচ না করে প্রকল্প শেষ করা। মোদী আরও জানান, উত্তর-পূর্বে ৩৪টি সড়ক প্রকল্পে ১০০১ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করা হবে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও ধসপ্রবণ উত্তর-পূর্বে রাস্তা তৈরিতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা প্রয়োজন। আগরতলা-বাংলাদেশ ব্যান্ডউইথ প্রকল্পের উল্লেখ করে মোদী বলেন, ‘‘উত্তর-পূর্বকে হাইওয়ের মতোই আই-ওয়েতেও এগিয়ে নেওয়া আমাদের লক্ষ্য।’’ বিদ্যুৎ ও রেলসম্প্রসারণ প্রকল্পেও ১০ হাজার কোটি টাকা করে বরাদ্দের কথা জানান প্রধানমন্ত্রী। বিশেষ গুরুত্ব দেন উত্তর-পূর্বের পর্যটন বিকাশ, জৈব চাষ এবং বিপিও ক্ষেত্রের উন্নয়নে।
এদিন পোলোর সভা থেকেই বোতাম টিপে মিজোরাম ও মণিপুরে ব্রডগেজ লাইনে ট্রেন চলাচল ও কামাখ্যা থেকে কাটরা—বৈষ্ণোদেবী সাপ্তাহিক ট্রেনের সূচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। পাশে ছিলেন রেলমন্ত্রী সুরেশ প্রভু। আমপাতিতে ৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি ফুটবল স্টেডিয়াম ও চেরাপুঞ্জির আধুনিক রাডার স্টেশনেরও বোতাম টিপে উদ্বোধন করেন মোদী। জানান, মেঘালয় তথা উত্তর-পূর্বে ফুটবল খেলার বিকাশে ২০১৭ সালের অনুর্দ্ধ ১৭ বিশ্বকাপকে কাজে লাগাবে কেন্দ্র।
মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এটিই ছিল রাজ্যের বাইরে সর্বানন্দ সোনোয়ালের প্রথম কর্মসূচি। সেখানে বিশেষ সাহায্যপ্রাপ্ত রাজ্যের সুবিধা আদায় করে ফিরছেন তিনি। যদিও প্রধানমন্ত্রী অসমকে কেন্দ্রীয় প্রকল্পে ৯০ ও ৮০ শতাংশ সাহায্যের আশ্বাস দেন, তবু সর্বানন্দ তাঁর স্মারকলিপিতে দাবি করেছেন: বন্যা ও ভূমিক্ষয় নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা, পরিকাঠামোহীনতা, কাঁচামাল, শিল্প, বিনিয়োগের অভাবের ফলে কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলির ১০০ শতাংশ ব্যয়ভার কেন্দ্র বহন করলেই ভাল হয়।
পাশাপাশি সর্বানন্দ জানান, মেঘালয় ও অসমের মধ্যে সীমানা বিবাদ আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা প্রয়োজন। সর্বানন্দ মোদীকে বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনদিনের অভিজ্ঞতায় দেখছি প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত প্রকল্পগুলির পূর্ণ সুবিধে অসম পাচ্ছে না।’’ তিনি ‘ডিজিট্যাল ইন্ডিয়া’ নীতির অধীনে অসমে উত্তর-পূর্ব ‘স্পেস অ্যাপ্লিকেশন সেন্টার’ গড়ার দাবি তোলেন। বলেন, ‘‘আগের সরকার বিশ্বের কাছে অসমকে সমস্যা জর্জরিত রাজ্য হিসেবে তুলে ধরেছিল। আমি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো ব্যবহার করে অসমকে উন্নততর রাজ্যই করে তুলব। ব্রহ্মপুত্র ও বরাক উপত্যকা এবং দু’টি পার্বত্য জেলার উন্নয়নে সমান গুরুত্ব দেওয়া হবে।’’ তাঁর মতে, উত্তর-পূর্ব পরিষদের প্রশাসনিক কাঠামোকে আরও সংগঠিত ও শক্তিশালী করতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গড়ে পরিষদের কর্মপদ্ধতি, অর্থনৈতিক ভূমিকা যাচাই করা দরকার। উত্তর-পূর্বে বেসরকারি বিনিয়োগ কম বলে পরিবহণ, স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, কৃষি, শিল্প, সেচ, পর্যটন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ও বন্যা নিয়ন্ত্রণে পরিষদের বিশেষ বিনিয়োগের বিষয়ে সর্বা জোর দেন। নানা প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণে বাজারদর অনুসরণ করা ও পরিষদের সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রাজ্য সরকারকে পাঁচ বছরের ‘মেনটেন্যান্স ফান্ড’ দেওয়ার আর্জিও জানান সোনোয়াল।