তীব্র রাজনৈতিক বিরোধিতার মধ্যেই ফের জমি অধ্যাদেশ জারি করে দিল নরেন্দ্র মোদী সরকার। এ ব্যাপারে মন্ত্রিসভার প্রস্তাবে আজ সম্মতি দিয়ে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়।
নরেন্দ্র মোদী জানেন, বিরোধীরা তাঁকে কৃষক-বিরোধী তকমা দিতে এ বার আরও তেড়েফুঁড়ে ময়দানে নামবে। ফলে সেই প্রচার-যুদ্ধে টক্কর দিতে মোদী আজই বার্তা দিয়েছেন গরিব ও চাষিদের। দাবি করেছেন, তাঁর সরকার মোটেই কৃষক-বিরোধী নয়। নিজেও তিনি চাষিদের মধ্যেই বেড়ে উঠেছেন। তাঁদের জীবনকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। এবং সে কারণেই তাঁর সরকার প্রাণ দিয়ে কাজ করছে তাঁদের জন্য।
লোকসভা ভোটের আগে মোদীর গরিব ঘর থেকে উঠে আসা, চায়ের দোকান চালানোর কথা তুলে ধরত তাঁর দল। নিজেও সুকৌশলে সেই ভাবমূর্তিকে কাজে লাগাতেন তিনি। এখন কংগ্রেস ও বাকি বিরোধীরা যখন নিজেদের রাজনৈতিক জমি ফিরে পেতে সরকারের জমি নীতিকেই মূল অস্ত্র করছে, তখন পাল্টা প্রচার-যুদ্ধে নেমে মোদী কার্যত ফের ভোটের আগের কৌশলেই ফিরলেন আজ।
জমি আইন সংশোধন করে তাকে শিল্প ও পরিকাঠামো উন্নয়নের সহায়ক করে তুলতে তিন মাস আগেই অধ্যাদেশ জারি করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। বিরোধীদের আপত্তিতে তা সংসদে পাশ না হওয়ার কারণেই আজ একই বিষয়ে দ্বিতীয় বার অধ্যাদেশ জারি করতে হল সরকারকে। সে দিক থেকে আজকের পদক্ষেপে বিশেষ নতুনত্ব নেই। বরং এ ব্যাপারে সরকারের পরবর্তী লড়াই নিয়েই এখন মূল আগ্রহ। প্রশ্ন মূলত দু’টি।
এক, নতুন অধ্যাদেশ সংসদে পাশ করাতে কী ভাবে ঘুঁটি সাজাচ্ছেন মোদী-জেটলি? অধ্যাদেশে আর কী কী নতুন সংশোধন আনার বিবেচনা করছে কেন্দ্র? দুই, জমি অধ্যাদেশকে কেন্দ্র করে মোদীর উপরে কৃষক-বিরোধী তকমা সাঁটার যে চেষ্টা বিরোধীরা চালাচ্ছেন, তার মোকাবিলা করা হবে কী ভাবে? বস্তুত, দিল্লিতে যখন আজ অর্ডিন্যান্স জারির প্রক্রিয়া চলছে, তখন বেঙ্গালুরুতে বিজেপির জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকে মোদী, অমিত শাহদের বক্তব্যে এই সব ভাবনারই প্রতিফলন দেখা গিয়েছে।
জমি আইন সংশোধন করে তা শিল্প-সহায়ক করে তোলার অঙ্গীকার ছিল মোদীর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি। সরকারের মতে, দেশে বিনিয়োগের সম্ভাবনা বাড়াতে অধিগ্রহণ আইন শিথিল করাটা অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে যাতে রাজনীতির জমিটাই সরে না যায়, সেটাই এখন বিজেপি তথা সঙ্ঘ পরিবারের মূল উদ্বেগ। দলের শীর্ষ নেতাদের মতে, পুরোটাই একটা ‘পারসেপশন ব্যাটেল’ তথা ধারণা তৈরির লড়াই। জমি অধ্যাদেশের সূত্র ধরে সামগ্রিক ভাবে বিজেপিকে কৃষক-বিরোধী প্রতিপন্ন করে দেওয়াই এখন বিরোধীদের মূল লক্ষ্য। এই ধারণা তৈরির লড়াইয়ে জিততেই মোদী আজ বেঙ্গালুরুর সভায় বলেছেন, ‘‘আমি তো আকাশ থেকে আসিনি। ছোটবেলা থেকে গরিব ও কৃষকদের মধ্যেই বড় হয়েছি। নিজের চোখে দেখেছি, কী করে কৃষকের ছেলেকে চাপরাশির চাকরির জন্য বাবাকে জমি বেচে ঘুষ দিতে হতো। তাই গ্রামের রাস্তা, স্কুল, সেচ, জল, বিদ্যুতের জন্য আমার সরকার প্রাণ দিয়ে চেষ্টা করছে।’’
এই সূত্রে জাতীয় পতাকার তিন রং আর মাঝের নীল অশোকচক্রের প্রসঙ্গ টেনে মোদী জানান তাঁর চারটি লক্ষ্যের কথা। প্রথমটি হল, দ্বিতীয় সবুজ বিপ্লব। যার নেতৃত্ব দেবে পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের পূর্ব প্রান্তের রাজ্যগুলি। দ্বিতীয় লক্ষ্য, শ্বেত বিপ্লব। দুধের উৎপাদনে বিপ্লব আনা। একই সঙ্গে যা নিরাপত্তা দেবে গবাদি পশুদেরও। মোদীর আর দুই লক্ষ্যের মধ্যে গেরুয়া, শক্তি বিপ্লবের প্রতীক। আর নীল, সমুদ্রে ভারতের শক্তি বিস্তারের।
বিজেপি সভাপতি অমিত শাহও কর্মসমিতির বৈঠকে বলেন, “স্বাধীনতার পরেও ব্রিটিশ জমানার অধিগ্রহণ আইন বলবত রেখেছিল কংগ্রেস। তার মাধ্যমে কোটি কোটি চাষির জমি কেড়ে নেওয়া হয়েছে। বিনিময়ে তাঁরা না পেয়েছেন উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ, না পেয়েছেন বিকল্প কর্মসংস্থান। প্রধানমন্ত্রী যে নতুন জমি নীতি প্রবর্তন করতে চলেছেন, তাতে কৃষকরা যেমন নায্য ক্ষতিপূরণ পাবেন, তেমনই বিকাশ ঘটবে গ্রামীণ পরিকাঠামোর।”
সামগ্রিক ভাবে কৃষক সমাজকে বার্তা দিতে বিজেপি সভাপতি আরও উল্লেখ করেন, কেন্দ্রে দশ বছর ক্ষমতায় থেকে কৃষিপণ্যের সহায়ক মূল্যই তুলে দেওয়ার বন্দোবস্ত করছিল কংগ্রেস। এ জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বৈঠকে অঙ্গীকারও করে এসেছিল ইউপিএ সরকার। সরকারের একটি সূত্র বলছে, শুধু রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া নয়, জমি নীতিতে আরও কিছু সংশোধন আনার কথাও বিবেচনা করছে কেন্দ্র। আগের অবস্থান থেকে কিছুটা নরম করে অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তত ৫১ শতাংশ কৃষকের প্রাক্-সম্মতি নেওয়ার প্রস্তাবে রাজি হতে পারে কেন্দ্র। কৃষকদের ক্ষতিপূরণও আরও কিছুটা বাড়ানোর কথাও বিবেচনা করছে সরকার। তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, খুব বেশি পরিবর্তনের সুযোগ নেই সরকারের। জমি-নীতি নিয়ে উল্টো পথে হাঁটলে শিল্প মহল আরও বিরূপ হয়ে পড়বে। সরকারের কাছে তাই গোটা ব্যাপারটা এখন দড়ির উপরে হাঁটার মতোই।
সরকারের এই সঙ্কটের কথা আঁচ করেই জমি অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে আরও আক্রমণাত্মক হচ্ছেন সনিয়া গাঁধী। কেন্দ্রের জমি নীতির বিরোধিতা করে ১৯ এপ্রিল দিল্লিতে কিষাণ সভার ডাক দিয়েছে কংগ্রেস। ওই সভায় অবির্ভাব ঘটতে পারে রাহুল গাঁধীরও। কংগ্রেস সূত্রের খবর, এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য কাল বিকেলে কংগ্রেস সদর দফতরে দিল্লির লাগোয়া রাজ্যগুলির কংগ্রেস সভাপতিদের বৈঠকে ডেকেছে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড।
জমি অধ্যাদেশ নিয়ে মোদী সরকারকে চাপে ফেলতে সক্রিয় হয়ে উঠেছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীবালও। আপ সূত্রে আজ বলা হয়েছে, মোদী সরকারের জমি নীতির বিরুদ্ধে ২২ এপ্রিল সংসদ ঘেরাও করবেন তাঁরা। কেজরীবাল নিজে সেই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পারেন।