নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের কারণে নতুন জট জিএসটি-তে ।
এত দিন পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, উত্তরপ্রদেশের মতো বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলি দাবি তুলছিল, নোট বাতিলের জেরে ব্যবসা-কেনাবেচা ধাক্কা খেয়েছে। তাই রাজ্যগুলির রাজস্ব ক্ষতি হতে পারে। এ বার একই অভিযোগ তুলল বিজেপি ও এনডিএ শাসিত রাজ্যগুলিও। সকলেরই প্রশ্ন, জিএসটি চালু হলে যতখানি রাজস্ব আয় কমতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, নোট বাতিলের ফলে ক্ষতির পরিমাণ তার থেকেও বেশি হতে পারে। সেই ক্ষতিপূরণের টাকা কোথা থেকে আসবে?
জিএসটি চালুর জন্য প্রথমে কেন্দ্রীয় বিক্রয় করের হার ধাপে ধাপে কমিয়ে আনতে হয়েছিল। সেই ক্ষতিপূরণ কেন্দ্র দেবে কি না, দিলেও কতখানি দেবে, তা নিয়ে ইউপিএ জমানায় দীর্ঘ দিন কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যগুলির টানাপড়েন চলেছে। তার পর প্রশ্ন ওঠে, জিএসটি চালুর পর রাজ্যগুলির আয় কমে গেলে সেই ক্ষতিপূরণ কে দেবে? অরুণ জেটলি রাজ্যগুলিকে পাঁচ বছরের জন্য পুরোপুরি ক্ষতিপূরণ মিটিয়ে দেওয়ার সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঐকমত্যের রাস্তা খুলেছিলেন। সেই অনুয়ায়ী সংবিধান সংশোধনও হয়েছিল। কিন্তু সে হল প্রাক-নোট বাতিল পর্ব। এ বার ক্ষতিপূরণের প্রশ্ন নিয়েই ফের কেন্দ্র বনাম রাজ্যগুলির সংঘাত শুরু হয়েছে।
এত দিন ক্ষতিপূরণের সমাধানসূত্র ছিল, জিএসটি-তে করের সর্বোচ্চ হার ২৮ শতাংশই বাঁধা থাকবে। কিন্তু তামাক, নরম পানীয়, পরিবেশের জন্য ক্ষতিকারক সরঞ্জাম, বিদেশি বিলাসবহুল গাড়ির মতো পণ্যের ক্ষেত্রে তার উপরও সেস বসবে। সেই সেস বাবদ আয় থেকেই রাজ্যগুলির ক্ষতিপূরণ মিটিয়ে দেওয়া হবে। পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রর বক্তব্য, ‘‘তখন হিসেবের মধ্যে নোট বাতিল ছিল না। শুধু মাত্র কিছু বড় রাজ্য, যাদের করের ভিতটাও বড়, তারা ভেবেছিল, রাজস্ব আয়ের বৃদ্ধি ১৪ শতাংশও হবে না। সেই হিসেবেই ক্ষতিপূরণ মেটাতে বছরে কেন্দ্রের ৫৫ হাজার কোটি টাকার মতো লাগবে। যা সেস থেকেই আদায় হবে বলে ধরে নেওয়া হয়েছিল।’’ কিন্তু নোট বাতিলের পরে এখন পরিস্থিতি বদলে গিয়েছে বলেই মনে করছেন তিনি। অমিত মিত্রের দাবি, ‘‘রাজনৈতিক দলমত নির্বিশেষে প্রায় সব রাজ্যই মনে করছে, তাদের ক্ষতিপূরণ প্রয়োজন। এমনকী মাঝারি রাজ্যগুলিও আশঙ্কা করছে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরে রাজস্ব আয় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমবে। অর্থ বছরের শেষ তিন মাসে আরও খারাপ যদি না-ও হয়, এর থেকে ভাল হবে না।’’ সে ক্ষেত্রে কত টাকা ক্ষতিপূরণ প্রয়োজন? অমিতবাবুর যুক্তি, ‘‘প্রথম বছরে ৭০ থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা লাগবে। জানুয়ারি থেকে মার্চে অবস্থা খারাপ হলে ৯০ হাজার কোটিও প্রয়োজন হতে পারে।’’
নোট বাতিলের ধাক্কায় যখন ব্যবসায় মন্দা, তখন সেস বসিয়ে কত টাকা উঠবে, সেই টাকায় রাজ্যগুলির বাড়তি ক্ষতি মেটানো যাবে কি না, তা নিয়ে সব রাজ্যের অর্থমন্ত্রীর মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। সেস বসিয়ে ক্ষতিপূরণের টাকা উঠবে না ধরে নিয়েই এখন সকলে দাবি তুলেছেন, সরকারি কোষাগার থেকে বা প্রয়োজনে ধার করে ক্ষতিপূরণ মেটাক মোদী সরকার। অমিতবাবু বলেন, ‘‘এ বিষয়ে সকলেই উদ্বিগ্ন। এমনকী বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিও। সমাধান একটাই, কেন্দ্রকেই বিকল্প উৎস খুঁজতে হবে।’’ বিজেপির কোনও অর্থমন্ত্রী এ নিয়ে প্রকাশ্যে তাঁদের বক্তব্য জানাননি। কিন্তু এনডিএ-র শরিক তেলুগু দেশম শাসিত অন্ধ্রপ্রদেশ মুখ খুলেছে। চন্দ্রবাবু নায়ডু সরকারের মন্ত্রী ওয়াই রামাকৃষ্ণুডুর যুক্তি, ‘‘সেস নয়, কেন্দ্রীয় সরকারের রাজকোষ থেকেই ক্ষতিপূরণ মেটাতে হবে।’’ আর এক এনডিএ-শরিক, পিডিপি নেতা, জম্মু-কাশ্মীরের অর্থমন্ত্রী হাসিব দ্রাবু বলেন, ‘‘শুধু সেস থেকেই ক্ষতিপূরণ মেটানো হবে, তা কোনও রাজ্য চায় না। তাই ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত বিলে বদল করা হবে। যেখানে ঋণ করেও ক্ষতিপূরণ মেটানোর সংস্থান থাকবে।’’
কী বলছেন অরুণ জেটলি?
কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীর জবাব, ‘‘জিএসটি চালুর ফলে যে ক্ষতি হবে, সেটাই পূরণ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। অন্য কোনও কারণের জন্য নয়।’’
কিন্তু রাজ্যগুলির দাবি, নোট বাতিলের একতরফা সিদ্ধান্ত কেন্দ্রের। কাজেই তার দায়ও কেন্দ্রকেই নিতে হবে। বিরোধী দলের অর্থমন্ত্রীরা বলছেন, জেটলি দায় ঠেলতে চাইছেন। আর বিজেপি শাসিত রাজ্যের অর্থমন্ত্রীরা ঘরোয়া ভাবে বলছেন, জেটলি আসলে প্রধানমন্ত্রীর কোর্টে দায় ঠেলছেন। নিজেরা মুখ খুলতে না পেরে তাঁরা অমিত মিত্রর মতো মন্ত্রীদের সরব হতে উসকে দিচ্ছেন। অর্থ মন্ত্রকের রাজস্ব দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘‘নোট বাতিলের ফলে যদি রাজ্যগুলির রাজস্ব আয় কমে, তা হলে কেন্দ্রেরও আয় কমবে। রাজ্যগুলিকে বুঝতে হবে, কেন্দ্রই বা বাড়তি টাকা কোথা থেকে পাবে!’’