ফোন, ই-মেলে মোদী পৌঁছবেন সব কর্মীর কাছে

কেন্দ্রের এক মন্ত্রী তাঁর সচিবকে ডেকে পাঠিয়েছেন নিজের মন্ত্রক সংক্রান্ত একটি বিষয় সবিস্তার জেনে নেওয়ার জন্য। সচিব এসে বললেন, ইতিমধ্যেই তিনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন। শুনে তো মন্ত্রী থ! মোদীর কার্যশৈলী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মন্ত্রী নিজেই শোনালেন তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা। বললেন, “প্রধানমন্ত্রী অনেক বিষয় মন্ত্রীদের কাছে জানার আগে সরাসরি সচিবদের কাছ থেকেই বিষয়টি বুঝে নিচ্ছেন।

Advertisement

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৪ ০২:২৪
Share:

কেন্দ্রের এক মন্ত্রী তাঁর সচিবকে ডেকে পাঠিয়েছেন নিজের মন্ত্রক সংক্রান্ত একটি বিষয় সবিস্তার জেনে নেওয়ার জন্য। সচিব এসে বললেন, ইতিমধ্যেই তিনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে ব্যাখ্যা করে বলেছেন। শুনে তো মন্ত্রী থ!

Advertisement

মোদীর কার্যশৈলী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মন্ত্রী নিজেই শোনালেন তাঁর এই অভিজ্ঞতার কথা। বললেন, “প্রধানমন্ত্রী অনেক বিষয় মন্ত্রীদের কাছে জানার আগে সরাসরি সচিবদের কাছ থেকেই বিষয়টি বুঝে নিচ্ছেন। ফলে আমাদেরও সব ব্যাপারে আরও ক্ষিপ্রতার সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে।”

ক’দিন আগের ঘটনা। কেন্দ্রের আর এক মন্ত্রী মহারাষ্ট্রে গিয়েছেন এক সংবর্ধনা সভায় যোগ দিতে। সেই সভা শেষ হতে না হতেই পড়িমরি করে দিল্লি ফিরতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন তিনি। দেখে রাজ্যের এক বিজেপি নেতা জানতে চান, অত তাড়াহুড়োর কী আছে? মন্ত্রী তাঁকে জানান, দফতর ছেড়ে বেশি ক্ষণ থাকার জো নেই মন্ত্রীদেরও। সময়ে-অসময়ে ফোন করেন খোদ প্রধানমন্ত্রী। তা-ও আবার মন্ত্রকে তাঁদের দফতরের ল্যান্ডলাইনে!

Advertisement

রাজনীতি হোক বা সরকারি কাজ, সরাসরি ও চটজলদি যোগাযোগ করাটাই নরেন্দ্র মোদীর কাজের ধারা। আর এই পথেই ‘সরকারি কাজ মানে আঠারো মাসে বছর’ কথাটাই মুছে ফেলতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। শুরুটা হয়েছে মন্ত্রী-আমলাদের নিয়ে। এ বার থেকে গোটা দেশের তাবৎ সরকারি কর্মীর সঙ্গেই সরাসরি যোগাযোগ রাখতে চান তিনি। এ জন্য দেশের মোট এক কোটিরও বেশি সরকারি কর্মীর ই-মেল আইডি ও ফোন নম্বরের তালিকা তৈরি করতে নির্দেশ দিয়েছেন ক্যাবিনেট সচিব অজিত শেঠকে।

কাজটা বিশাল। তবু এ ক্ষেত্রেও গদাইলস্করি চালের সুযোগ রাখেননি মোদী। ১৫ অগস্ট প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম বার লালকেল্লা থেকে বক্তৃতা দেবেন তিনি। তার আগেই ওই তালিকা তৈরি করতে হবে। যাতে সেই দিন থেকেই প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাবনা ও পরিকল্পনা সরাসরি জানাতে পারেন সরকারি কর্মীদের। কেন্দ্রের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক তাই যুদ্ধকালীন ভিত্তিতে সরকারি কর্মীদের তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করে দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ক্যাবিনেট সচিব প্রতি সপ্তাহেই এই বিষয়ে বৈঠক করছেন।

যোগাযোগ-প্রযুক্তির ব্যবহারের ক্ষেত্রে মোদী যে আর পাঁচ জনের থেকে আলাদা, সেটা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন এ বারের লোকসভা ভোটের প্রচারেই। ইন্টারনেটে তিনি প্রচার-যুদ্ধে নামিয়েছিলেন এক ঝাঁক তরুণকে। কংগ্রেসের আক্রমণকে ব্যুমেরাং করে তুলতে দেশের বিভিন্ন শহরে বাছাই করা চায়ের দোকানে তিনি হাজির হয়েছেন বড় পর্দায়। সেই ‘চায়ে পে চর্চা’-র আসরে তিনি যেমন ভোটারদের কথা শুনেছেন, তেমনই গুজরাতে বসে গোটা দেশকে শুনিয়েছেন নিজের ভাবনাচিন্তার কথা। হলোগ্রাফি প্রযুক্তির মাধ্যমে একই সময়কে বহু গুণ করে তোলা বা ‘টাইম মাল্টিপ্লিকেশন’-নেও তিনি দেশের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এগিয়ে। এক জায়গায় থেকেই ত্রিমাত্রিক ছবি হয়ে তিনি পৌঁছে গিয়েছেন দূরের একাধিক শহরে জনসভার মঞ্চে। নিজে না গিয়েও সরাসরি ভাষণ দিয়েছেন মাঠে উপস্থিত দলীয় কর্মী, সমর্থক ও ভোটারদের উদ্দেশে।

ভোট পর্বের পরে এ বার প্রশাসন পর্বেও মোদী তার নিজস্ব ঘরানা গড়ে তুলছেন। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় সূত্রের মতে, মোদীর প্রশাসনের পদ্ধতিই হল, সকলকে সামিল করে সরকার পরিচালনা করা। এর জন্য ই-গভর্ন্যান্সের উপরে তিনি বিশেষ জোর দিচ্ছেন। দিল্লিতে বসে শুধু নীতি প্রণয়নই তাঁর লক্ষ্য নয়। যে কারণে রাজ্যগুলির হাতেও অধিক ক্ষমতা দেওয়া তাঁর দর্শনে রয়েছে। সরকারি কর্মচারীরাও সরকারেরই অঙ্গ। সরকার যে সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি তাঁদেরই রূপায়ণ করতে হয়। অথচ তাঁরাই থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। সরকারের ওপরতলা থেকে তাঁদের কাছে সব বার্তাই পৌঁছয় অজস্র ধাপ পেরিয়ে। লিখিত নির্দেশ বা সার্কুলারের আকারে। প্রশাসনের এই ধারাটাই বদলে ফেলতে চান মোদী।

সরকার কী ভাবছে, কর্মীরা সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল থাকলে তাঁদেরই কাজের সুবিধা হবে। এ জন্য ইতিমধ্যেই সব মন্ত্রীকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। যাতে সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সরাসরি মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। মানুষের কোনও অভিযোগ বা সমালোচনা থাকলেও এই মাধ্যম ব্যবহার করে জানাতে পারেন। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকই মন্ত্রীদের সেই কাজে সাহায্য করছেন।

এ বারে সরকারি কর্মচারীদের সঙ্গেও একই ভাবে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে যদি সরকারি কর্মীদের কাছে বার্তা যায়, তা হলে তাঁদেরও মনোবল বাড়বে। দিল্লির সঙ্গে তাঁদের দূরত্বও ঘুচবে। বিভিন্ন মন্ত্রকের সচিবকে মোদী নিজেই নির্দেশ দিয়েছেন, প্রয়োজন হলে সরাসরি তাঁর সঙ্গে কথা বলতে। দরকারে প্রধানমন্ত্রী নিজেও সরাসরি সচিবদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।

তবে প্রধানমন্ত্রী চাইলেও কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব ঘোচানোর জন্য প্রয়োজনীয় তথ্যভাণ্ডার গড়ে তুলতে গিয়ে যথেষ্টই বেগ পেতে হচ্ছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রককে। মন্ত্রকের কর্তারা জানাচ্ছেন, অনেক সরকারি কর্মীই ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। অনেকের হাতে মোবাইল থাকলেও ই-মেলের সঙ্গেও অনেকে পরিচিত নন। তার উপর দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ইন্টারনেট বা মোবাইল পরিষেবাও নেই। সে কারণে প্রযুক্তি মন্ত্রকের সঙ্গেও আলোচনা করতে হচ্ছে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের সূত্রের দাবি, এখনও পর্যন্ত প্রায় ৫০ লক্ষ শিক্ষক, ১০ লক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী ও ৩০ লক্ষ পঞ্চায়েত প্রধানের ফোন নম্বর ও ই-মেল জোগাড় করা হয়েছে। আরও জোগাড় করা হচ্ছে। এই সব নম্বর ও ই-মেল ঠিকঠাক কিনা, তা-ও খতিয়ে দেখছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক।

মোদী ঘরানায় চলতে গিয়ে এমন চাপ নিতে হচ্ছে অন্য সব মন্ত্রককেও। উপভোক্তা বিষয়ক, খাদ্য ও গণবন্টন মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী দাদারাও দানভে তো বলেই ফেললেন, “নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে কাজ করাটা আদৌ সহজ নয়। মাত্র এক মাসে আমার চার কেজি ওজন কমেছে। ভোটের সময়ও এত খাটতে হয়নি। এখন সরকারে এসে খাটনি বেড়ে গিয়েছে বহু গুণ।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন