সাবরমতী থেকে ইয়াং জি কিয়াং!
সেপ্টেম্বরে সাবরমতী আশ্রমে চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং-এর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সূচনা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এ বার সেই সম্পর্কের দ্বিতীয় পর্যায় রচিত হতে চলেছে। মে মাসে মোদীর বেজিং সফর। বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত দিক থেকে মোদীর আসন্ন সফর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের প্রশ্নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে।
গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই চিনের সঙ্গে মোদীর সম্পর্ক সাবলীল। কিন্তু কেন্দ্রে সরকার গড়ার পরে স্বাভাবিক ভাবেই বেজিংয়ের সঙ্গে নরম গরম নীতি নিয়ে চলতে হচ্ছে মোদীকে। কিন্তু বাধ্যবাধকতার মধ্যেও বৃহত্ শক্তিধর প্রতিবেশীর কাছ থেকে নিজ শর্তে যতটা সম্ভব লাভ আদায় করে নিতে চান মোদী। পাশাপাশি, চিনও চাইছে মোদীর সংস্কারপন্থী নীতির হাওয়ায় নিজেদের বিনিয়োগ যতটা সম্ভব বাড়িয়ে নিয়ে যেতে। এ জন্য আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং কৌশলগত ক্ষেত্রে নয়াদিল্লিকে কিছুটা ছাড় দেওয়ার কথাও ভাবছে বেজিং। এই সময়ে দু’দেশের মধ্যে যে চুক্তিপত্রগুলি সই হবে, তার মোট অঙ্ক ১ হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে যেতে চলেছে। পাশাপাশি সেপ্টেম্বরে ঘোষিত চিনা বিনিয়োগের (এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা) কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে, তা-ও খতিয়ে দেখবেন দুই দেশের শীর্ষ নেতা।
বাণিজ্যের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের মর্যাদা বাড়াতেও বেজিং সফরকে ব্যবহার করতে চান মোদী। রাষ্ট্রপূঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্যপদ পেতে নয়াদিল্লিকে প্রকাশ্যে সমর্থন না করতে পারলেও এ ব্যাপারে তাদের এত দিনের নেতিবাচক সুর কিছুটা হলেও বদল করতে পারে চিন। সূত্রের খবর, নিরাপত্তা পরিষদে চিন যে ভারতকে ‘বৃহত্তর ভূমিকায়’ দেখতে চায়, সে কথা মোদীকে জানাবেন শি চিনফিং। চিনের এই অবস্থান যাতে যৌথ বিবৃতিতে রাখা যায়, তা নিয়েও চেষ্টার কসুর করবে না নয়াদিল্লি। ঘটনা হল, গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য পদ পেতে দরবার করে আসছে ভারত। এই ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি বাগড়া দিয়ে এসেছে বেজিংই। চিনের বক্তব্য, পরমাণু সম্প্রসারণ বিরোধী চুক্তিতে (এনপিটি) সই না-করা ভারতের মতো কোনও দেশকে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে সামিল করা উচিত নয়।
আরও একটি ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগের প্রতি এ বার নজর দিতে পারে বেজিং। ভারত মহাসাগরের একটি বড় অংশে চিন তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছে মনমোহন জমানার গোড়া থেকেই। বিষয়টি নিয়ে সন্দিহান হয়েছে দেশের নিরাপত্তা সংস্থাগুলি। শ্রীলঙ্কার হানবোনটোটা, বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, পাকিস্তানের গদরে বন্দর নির্মাণের কাজে চিন বিনিয়োগ করেছে। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার আশঙ্কা, এই নির্মাণের মোড়কে চিন আসলে তাদের সামরিক ঘাঁটি বাড়াতে চলেছে। নয়াদিল্লির আশা, মোদীর সঙ্গে চিনা নেতৃত্বের আসন্ন বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে স্বচ্ছতার প্রতিশ্রুতি দেবেন চিনা নেতৃত্ব। এই সিল্ক রুটের চিনা উদ্যোগে ভারতকেও সামিল করার জন্য কিছু প্রস্তাব দেওয়া হবে বেজিংয়ের পক্ষ থেকে। মোদীর নতুন পরিকল্পনা প্রাচীন ‘কটন রুট’কে নবজাগরিত করার বিষয়েও ভারতের কাছে জানতে চাইবে বেজিং। এ ব্যাপারে একত্রে কাজ করা যায় কিনা তা-ও খতিয়ে দেখতে অনুরোধ করা হবে মোদীকে। এক কথায়, ভারত মহাসাগরে ভারতের সঙ্গে একটি সাময়িক সন্ধি করার ইঙ্গিত দেবে চিন।
পাশাপাশি যে বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব পেতে চলেছে মোদীর সফরে, তা হল বাণিজ্য। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যাবেন একটি বিরাট বাণিজ্য প্রতিনিধিদল। মোদী বৈঠক করবেন বাণিজ্য কর্তাদের সঙ্গেও। গুজরাত এবং পুণেতে এর আগেই দু’টি শিল্প পার্ক গড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভারত-চিন। সে ব্যাপারে কাজ কতটা হয়েছে, দু’টি পার্কে আরও বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা, তা নিয়েও কথা হবে।
সেপ্টেম্বরে ষোলোটি চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন ভারত এবং চিনের মন্ত্রী ও আমলারা। যার মধ্যে রয়েছে কৈলাস যাত্রার জন্য নতুন যাত্রা পথের ঘোষণা, আমদাবাদ- গুয়ানঝাও আর মুম্বই-বেজিং-এর মধ্যে সমঝোতা মৈত্রী, চেন্নাই বেঙ্গালুরু ও মহীশূরের মধ্যে সেমি হাই স্পিড রেল প্রকল্প। এগুলির অগ্রগতি নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি মোদীর আসন্ন সফরে ওষুধ-সহ বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্রে চিনা বাজার ভারতের জন্য খুলে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হবে নয়াদিল্লি।