রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় নাকচ করেছিলেন আগেই। এ বার সুপ্রিম কোর্টেও খারিজ হল ১৯৯৩-এ মুম্বই হামলার অন্যতম চক্রী ইয়াকুব মেমনের সংশোধনী আবেদন। অর্থাৎ বহাল থাকল ফাঁসির আদেশই। ফাঁসির দিন ঠিক ৩০ জুলাই। এ দিন আবার ইয়াকুবের জন্মদিনও। কৌঁসুলির মারফৎ ইয়াকুব অবশ্য আজই বিকেলের পর ফের প্রাণভিক্ষার আর্জি জানিয়েছে মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালের কাছে।
২৬/১১ (মুম্বই, ২০০৮) হামলার দায়ে ২০১২-য় ফাঁসি হয় লস্কর জঙ্গি আজমল কসাবের। কিন্তু ১৯৯৩-এর পর ২২ বছর পেরোলেও সেই মামলায় ফাঁসি হয়নি এক জনেরও। গোয়েন্দা সূত্রে দাবি, হামলার মূল চক্রী দাউদ ইব্রাহিম গা-ঢাকা দিয়ে রয়েছে পাকিস্তানে। পলাতক ইয়াকুবের ভাই টাইগার মেমনও। তবু আজ সুপ্রিম কোর্টের রায়ে স্বস্তি দেশের একটা বড় অংশে। মহারাষ্ট্র প্রশাসন সূত্রের খবর, আদালতের নির্দেশিকা মেনেই ৩০ জুলাই ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হবে। ইয়াকুব (৫৩) এখনও নাগপুর সেন্ট্রাল জেলে। তবে ফাঁসির জন্য তাকে পুণের ইয়ারওয়াড়া জেলে (যেখানে কসাবকে ফাঁসি দেওয়া হয়) নিয়ে যাওয়া হবে কি না, ধন্দে প্রশাসন। মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফডনবীসের দাবি, ফাঁসির প্রস্তুতি চলছে জোর কদমে। খবর পাঠানো হয়েছে তার পরিবারকেও। ফাঁসুড়ে বাইরে থেকে আনা হচ্ছে না। নাগপুর জেলেরই তিন কনস্টেবলকে ফাঁসি দেওয়ার বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেল কর্তৃপক্ষ। প্রশাসনের একাংশ অবশ্য ইয়াকুবের আর্জি নিয়ে রাজ্যপাল বিদ্যাসাগর রাও কী বলেন, সে দিকে তাকিয়ে।
২০০৭-এ মুম্বই হামলার অন্যতম চক্রী হিসেবে দোষী সাব্যস্ত করে ইয়াকুবকে মৃত্যুদণ্ড দেয় মুম্বইয়ের সন্ত্রাস দমন আদালত। সেই রায়ের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আবেদন করে ইয়াকুব। প্রথমে সুপ্রিম কোর্টে এবং পরে রাষ্ট্রপতির কাছে। এবং প্রত্যেক বারই তা খারিজ হয়ে যায়। কিছুটা স্বস্তি মেলে গত বছরের মাঝামাঝি। ইয়াকুব জানায়, সে অসুস্থ। তাই তার মৃত্যুদণ্ড মাফ করা হোক। যার জেরে ২০১৪-র জুনে ইয়াকুবের মৃত্যুদণ্ডের উপর স্থগিতাদেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট। আদালতের রায়ে আজ উঠল সেই স্থগিতাদেশও। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, ইয়াকুব কি সত্যিই অসুস্থ? সাম্প্রতিক এই আর্জিতে ইয়াকুব জানিয়েছিল, ১৯৯৬ সাল থেকেই সে স্কিৎজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত। তা ছাড়া প্রায় বিশ বছর সে জেল খেটেছে। আজ প্রধান বিচারপতি এইচ এল দাত্তুর বেঞ্চে অবশ্য এ সব যুক্তি ধোপে টেকেনি। আদালত সূত্রে খবর পাওয়া মাত্রই এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান বিশেষ সরকারি কৌঁসুলি উজ্জ্বল নিকম। বিস্ফোরণ মামলার শুনানি শুরু হয় নিকমের হাত ধরেই। আদালতের রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ আখ্যা দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘ফাঁসির আদেশ বহাল রেখে আদালত বার্তা দিল, সন্ত্রাসবাদে জড়িত কাউকেই রেয়াত করা হবে না।’’ শিবসেনার শীর্ষ নেতা রামদাস কদম আবার কেন্দ্রকে সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, ‘‘ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রীকে। নরেন্দ্র মোদী বুঝিয়ে দিলেন দেশে সন্ত্রাসবাদী কাজের শাস্তি একটাই— ফাঁসি।’’
সরকারি পরিসংখ্যান মোতাবেক, ১৯৯৩-এর সেই ধারাবাহিক বিস্ফোরণে মুম্বইয়ে প্রাণ যায় ৩৫০ জনের। আহত হন প্রায় ১২০০। হামলার মূল দুই চক্রী দাউদ ও টাইগার ঘটনার পর থেকেই দেশছাড়া। ১৯৯৪-এ নয়াদিল্লি স্টেশনে ধরা পড়ে ইয়াকুব। তার অবশ্য দাবি, সে আত্মসমর্পণ করেছিল। শুনানির শুরুতে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয় আরও ১০ জনকে। পরে অবশ্য তাদের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়। রেহাই মেলেনি শুধু ইয়াকুবের।
কী তার অপরাধ? তদন্তকারীদের দাবি, ‘মেধাবী’ ইয়াকুবই মুম্বই হামলার অন্যতম মাথা। অভিযোগ, হামলার মাস কয়েক আগে থেকেই দাউদের সঙ্গে যোগাযোগ চালাতে থাকে সে। দুবাইয়ে গিয়ে দাদা-ভাই মিলে বানায় ১৯৯৩ হামলার নীল-নক্শা। দাউদের নির্দেশেই হামলা কার্যকর করার ভূমিকা নেয় ইয়াকুব। তার হাত দিয়ে প্রায় ২২ লক্ষ টাকার লেনদেন হয়েছিল বলে তদন্তে প্রমাণিত। এ ছাড়া, মেমন পরিবারের বেশ কয়েকটি গাড়িও বিস্ফোরণে ব্যবহৃত হয় বলে অভিযোগ। ইয়াকুব সরাসরি ময়দানে না নেমেও জঙ্গিদের অস্ত্র, বিস্ফোরক সরবরাহ এমনকী মুম্বই থেকে ভায়া দুবাই পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে প্রশিক্ষণের বন্দোবস্ত করে বলেও দাবি তদন্তকারীদের। ইয়াকুবের পরিবারের অবশ্য দাবি, পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট তাদের এই ছেলেটাই সব চেয়ে মেধাবী ছিল। নাগপুর জেলে বসেই সে ইংরেজি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পায়। আদালত যদিও আজ সে সবে একেবারেই আমল দেয়নি।